Man's dearest possession is life. It is given to him but once, and he must live it so as to feel no torturing regrets for wasted years, never know the burning shame of a mean and petty past; so live that, dying he might say: all my life, all my strength were given to the finest cause in all the world- the fight for the Liberation of Mankind. - Nikolai Ostrovsky

Friday, December 21, 2012

ভারতীয় বিপ্লবের পথ—কমরেড স্তালিনের শিক্ষা ও ভারতীয় পরিস্থিতির বাস্তবতা - বাসু আচার্য (স্তালিন স্মারক বক্তৃতা, এই তো সময়)

আজকের পরিস্থিতি ও স্তালিন’ – বিষয়টা প্রথম শুনেই প্রশ্ন জেগেছিল, আজকের পরিস্থিতি মানে কোন পরিস্থিতির কথা বলা হচ্ছে? বাঙ্গালী যেমন আন্তর্জাতিক তেমনই কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভীষণ প্রাদেশিক। ফলে প্রথমেই বাংলা সংক্রান্ত ব্যাপারটাই আমার মাথায় এসেছে।
আমাদের নাক উঁচু হওয়ার কোনও সঙ্গত কারণ আদৌ আছে কিনা আমি জানি না, তবু এটা স্বীকার না করে উপায় নেই যে মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী বেজায় নাকউঁচু। আর এই প্রবণতা থেকেই বিহারের লালু যাদব বা রাবড়িদেবী, কিংবা উত্তর প্রদেশের মায়াবতী-মুলায়মদের নিয়ে আমরা এতদিন হাসাহাসি করে এসেছি। আজ আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কুমারী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃপায় এই ঔদ্ধত্যের খাস মহলে খানিক চিড় ধরেছে। গোবলয়ও আজ আমাদের দেখে হাসছে। এহেন পোয়েটিক জাস্টিস যার দয়ায় আমার আপনার ওপর বর্ষিত হচ্ছে, তাঁর রাজ্য শাসনের আধা ফ্যাসিস্ত ধরনের কথা ভেবেই কি এমন বিষয় নির্বাচন?
কথাটা এক বন্ধুকে বলতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘ওসব নয়, নয়া উদারনীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে কমরেড স্তালিন-এর পথ অবলম্বন করে যে উন্নয়ন করা যায়, এটাই হল আসল কথা। ডেভেলপমেন্ট উইথ ডিগ্নিটি। তাছাড়া রেজিমেন্টেশনের ব্যাপারটাও তো আছে। কোনও কেন্দ্রিকতা মানি না বলেপার্টিটাকেই জাহান্নমে পাঠিয়ে দেওয়া!...আর একজন তর্কপ্রিয় বন্ধু সেটা শুনেই বলে উঠল, ‘রেজিমেন্টেশনের ব্যাপারটা হতে পারে, কিন্তু উন্নয়ন নয়। হোয়াট এইলস ইন্ডিয়ান লেফট?’ –এটার উত্তর চাই। মোদ্দা কথা হল বিশ্বপুঁজিবাদ যেখানে গত কয়েক দশক ধরে ভেন্টিলেশনে শুয়ে খাবি খাচ্ছে, সেখানে আমরা কিছুতেই মিলে মিশে পুঁজিবাদের নাক থেকে নলটা খুলে নিতে পারছি না, নিজেরাই নিজেদের সাথে ঝামেলা মারপিট করে শেষ হয়ে যাচ্ছিজনগণ হতাশ হচ্ছেন, আর এই সুযোগে ইতিহাসের আস্তাঁকুড়ে নিক্ষিপ্ত বদমায়েশগুলোকে তুলে এনে গায়ে স্পিরিট ঘোষে তাত্ত্বিক বাবা-জ্যাঠা বানিয়ে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। ছাড়ছে দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদী পাণ্ডারা। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর দয়ায় তাই পোস্ট মডার্নিজম থেকে ট্রটস্কিজম-এর ছড়াছড়ি। এই পরিস্থিতিতে চকচকে ইস্পাতের যে পাতটা তোমার বইয়ের আলমারিতে ১৪ ভাগে পড়ে আছে, সেটাকে ফেলে রেখে মর্চে ধড়িয়ে দেবে না-কি তার থেকে একটা ধারালো তলোয়ার বানিয়ে নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখবে?’
বলা বাহুল্য, তিনটে সম্ভাবনার কোনওটাই নেহাত ফেলে দেবার মত নয়। কোথাও হয়তো এগুলোর মধ্যে একটা মিলও আছে। গত ছদশকেরও বেশী সময় ধরে স্তালিনের রচনাবলী আমার আপনার বুকশেলফের শোভাবর্ধন করে চলেছে। তার সাথে ৭এর দশকে চিন থেকে বেরোনো অন দি অপজিশনবা প্রবলেমস অব লেনিনিজম’-ও রয়েছে, রয়েছে মার্কসবাদ ও ভাষা সমস্যা’, রয়েছে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সমস্যাবলী। এত বছরে এগুলো থেকে আমরা হয় কিছু কোটেশন সংগ্রহ করে বৌদ্ধিক আত্মরতিতে ব্যস্ত থেকেছি, নয়তো রুপোলী পতঙ্গের পেট ভরাবার উপকরণ হিসাবে এগুলোকে ব্যাবহার করেছি। হঠাৎ ২০১১-তে থ্রোন থেকে ওভারথ্রোন হওয়ার কারণে খানিকক্ষণের জন্য হকচকিয়ে গেছি, এবং আজ, কোনও উপায় না থাকায়, আবার স্তালিনে ফেরার চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি অন্য পথ খুঁজে বার করার।
তবে সমস্যা হ, দরখাস্ত বিছিয়ে বা আইডেন্টিটি পলিটিক্স করে তো পথ চেনা যায় না, স্থবিরতা বজায় রেখে কেবলমাত্র টিকে থাকার মানসিকতা নিয়েও নয়। যা হয়েছে, তা তো গত তিন দশকের রাজনীতির লজিকাল কনক্লুশন। স্তালিন বলতেন, ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসি ব্রিডস ফ্যাসিজম’, কথাটা হাড়ে হাড়ে সত্য প্রমাণিত আজ। বাংলার মাটিতে যা দেখছি তা ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের এত বছরের গবেষণার ফসল। আমাদের চিন্তার জগতে, আমাদের মগজে কারফিউএমন একটা অবস্থা যে, মেরুদণ্ডটাও প্লাস্টিকের হয়ে গেছে। তাই মাথায় একটা উথাল-পাথাল ঘোটে না গেলে, এই ২০১২ সালের শেষেও, পথ আর ফাঁদের মধ্যে তফাতটা করে উঠতে পারব না, বুঝে উঠতে পারব না— পুঁজি যে পথে হেঁটে আসে, সেটাই রক্তে কাদা হয়ে যায়; বিপ্লব না হলে নেপের উদাহরণ টানার কোনও অর্থ থাকে না, ভাবের ঘরে চুরি করা ছাড়া। বুঝে উঠতে পারব না যে, রাইফেলের বোল্ট টেনে যারা দেশের নানান কোণায় জল-জঙ্গল-জমি লুট হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে সজাগ প্রহরায় দাঁড়িয়ে, কিছু বিকৃতি স্বত্বেও তাঁরাই স্তালিনের প্রকৃত উত্তরসূরিঘরে-বাইরে, দু জায়গাতেই বাধা-বিপত্তি সামলে এগিয়ে চলেছেন তাঁরা। তাঁদের অনুশীলনের যেটুকু ভ্রান্তি, সেটুকু এক না একদিন দূর হবে, কেননা তাঁরা আছেন অনুশীলনের মধ্যেই। যে লোহা আগুনে রয়েছে, তাতে মর্চে পড়ে না। আমাদের আজ ঠিক করতে হবে আমরা কোন দিকে যাব, ক্ষতরস সন্ধানী মাছিদের দিকে নাকি শত্রু আঘাতের চিহ্ন নিয়ে অনেক ভুল করে যে বীর একটা সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়ে গেলেন তাঁর দিকে? ভ্রান্তি বা বিচ্যুতির মাত্রা বাড়লে তাঁদের নির্মমভাবে সমালোচনা করবো, কারণ যে ঘৃণ্য তাকে শুধুই ঘৃণা করা যায়, কিন্তু যিনি আমার আপনার প্রকৃত বন্ধু, তিনি ভুল করলে তাঁকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া চাই। তাঁর কাছে প্রত্যাশা যে অনেক বেশী। এঁরা যুগ যুগ ধরে প্রমাণ করেছেন, স্তালিন মানে মতাদর্শের ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা, স্তালিন মানে হিম্মৎ, সত্যি বলার হিম্মৎ, স্রোতের প্রতিকুলে চলার জন্য কলজেতে জন্ম নেয় যে আত্মপ্রত্যয়, তারও নাম স্তালিন।
যাইহোক, আজকের বিষয় যেহেতু বর্তমান পরিস্থিতি ও স্তালিন’, তাই বহু বছর ধরে চলে আসা এক দেশে সমাজতন্ত্র সম্ভব না সম্ভব নয়, সোভিয়েতে শ্রেণী বিলুপ্ত হয়েছে ১৯৩৬-এ করা স্তালিনের এই দাবী কতখানি ভুল ছিল, কিংবা স্তালিন আমলের যে আমলাতান্ত্রিক বিচ্যুতির কথা ট্রটস্কি বলেছেন তা কতখানি ঠিক, স্তালিন আমলাতন্ত্রকে পোষণ করতেন না উচ্ছেদ করতে চাইতেন, তিনি খুনি ও কর্তৃত্ববাদী ছিলেন না ছিলেন-না, ইত্যাদি বিতর্কগুলো না হয় পরে আলোচনা করা যাবে। যাঁরা তাত্ত্বিক ও যোগ্য মানুষ, তাঁরা বলবেন। এখন বরং ভারতের বিপ্লবের পথ নিয়ে স্তালিনের যে সুচিন্তিত মতামত ছিল তারই বিশ্লেষণ করা যাক আজকের পরিপ্রেক্ষিতে।
ভারতের বিপ্লবের পথ প্রসঙ্গে স্তালিনের মতামত কি ছিল, তা আলোচনা করার আগে তৎকালীন অবস্থার দিকে একবার তাকান দরকার—
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগ। আন্তর্জাতিকভাবে পৃথিবী দুটো ক্যাম্পে ভাগ হয়ে গেছে। এক দিকে মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তার দাসানুদাসরা, অন্যদিকে সোভিয়েতের নেতৃত্বে প্রগতিশীল দেশগুলো এবং জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিক জনগণ। সাম্রাজ্যবাদ তখন পিছু হটেছে। তার ঔপনিবেশিক নীতি চেহারা নিয়েছে নয়াউপনিবেশবাদের। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ ভারত ছেড়েছে। ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে গেছে খণ্ডিত ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান গঠনের ভেতর দিয়ে, কম্যুনিস্ট পার্টির দপ্তরের বাইরে লাল পতাকার সাথে সাথে উড়েছে তেরঙ্গা। মধ্য রাত্রে পার্টির সম্পাদককে দেখা গেছে কুয়ো থেকে বালতি বালতি জল তুলে গায়ে ঢালতে; প্রশ্ন করা হলে উত্তর দিয়েছেন—‘আই অ্যাম ওয়াশিং আওয়ে মাই গুলামি। কিন্তু এই আবেগ স্থায়ী হয় নি। মালিক সাহেব গিয়ে গোলাম সাহেব এসেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চারণভূমিতে আরও অনেক অংশীদার, আছে মার্কিনীরাও। নমিনাল পলিটিকাল ইন্ডিপেন্ডেন্সের জোরে কখনো এদিক থেকে কখনো ওদিক থেকে কাজ চালাচ্ছেন সরকার বাহাদুর। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোয় সাম্রাজ্যবাদের ফাঁস কসে বসে গেছে।
এমতাবস্থায়, ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে, ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস বসে কলকাতার মহম্মদ আলি পার্ক চত্বরে। পূরণচাঁদ যোশীকে সরিয়ে সম্পাদক করা হয় বিটি রণদিভেকে। গৃহীত হয় সংযুক্ত বিপ্লব বা ইন্টার্টওয়াইন্ড রেভোল্যুশনের লাইন, সশস্ত্র শহুরে অভ্যুত্থানের কৌশল। অন্যদিকে তেলেঙ্গানায় শুরু হয় নিজামশাহীর বিরুদ্ধে একদা পরিচালিত কৃষক সংগ্রামের নয়া যুগনতুন শত্রুর নাম নেহরু-প্যাটেল সরকার। এখানকার নেতৃত্ব মানতে পারেন নি আরবান ইনসারেকশনের কৌশল। কিন্তু তাঁরা যে বিশেষ চিঠি দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে তা নতুন নেতৃত্ব আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন, মাও সেতুং-কে বলেছেন পেটি পেজেন্ট লিডার
তবে, দেড় বছরের মাথায় বেরিয়ে পড়ে সংযুক্ত বিপ্লবের কংকাল। কমিনফর্মের মুখপত্র ফর এ লিস্টিং পিস অ্যান্ড ফর এ পিপলস ডেমোক্রেসি’-র পাতায় প্রকাশিত হয় নতুন সম্পাদকীয় যাতে বলা হয় চিনের পথই ভারতের পথ। টিঁকে থাকার অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত বিটিআর সরে যেতে বাধ্য হন, জরুরী অধিবেশনের ভেতর দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি রিকন্সটিটীউট করে সম্পাদক করা হয় তেলেঙ্গানার প্রধান নেতা রাজ্যেশ্বর রাওকে, আওয়াজ ওঠে দিকে দিকে তেলেঙ্গানা তৈরির। কিন্তু এখানেও বিতর্ক পিছু ছাড়ে নি সিপিআই-এর। পার্টির তিন দায়িত্বশীল নেতাঅজয় ঘোষ, শ্রীপাট দাঙ্গে ও এস,ভি, ঘাটে অভিযোগ করেন, বিটিআর-এর সংযুক্ত বিপ্লবের মত দিকে দিকে তেলেঙ্গানা গড়ে তোলার লাইনও সম্পূর্ণ হঠকারী, অতএব পরিত্যাজ্য। অবস্থা এমনই হয়ে দাঁড়ায় যে মীমাংসার কোনও সহজ রাস্তাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই শেষ আশা সোভিয়েত, স্তালিন।
১৯৫১ সালের শুরুতে সিপিআই-এর চার নেতারাজ্যেশ্বর রাও, বাসবপুন্নাইয়া, অজয় ঘোষ এবং শ্রীপাট দাঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নে যান স্তালিনের সাথে দেখা করতে। ৯-ই ফেব্রুয়ারি সন্ধেবেলায় স্তালিন তাঁদের সাথে দেখা করেন। ভারতীয় বিপ্লবের সমস্যা সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা হয়। শুরুতেই স্তালিন জানান, রুশ কম্যুনিস্টরা ভারতীয় বিপ্লবকে মূলত কৃষি বিপ্লব হিসাবে দেখেন, অর্থাৎ সামন্ততান্ত্রিক কর্তৃত্ব ভেঙে কৃষক সমাজের হাতে জমির অধিকার দেওয়া, যাতে তা তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে উঠতে পারে। বুর্জোয়ারা যেহেতু পুঁজির একচেটিয়াকরণের যুগে তাদের প্রগতিশীল সামন্ততন্ত্র-বিরোধী চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে, সেহেতু তাদের কাজটাই করবে কম্যুনিস্টরাজনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রথম ধাপে। স্তালিন এও বলেন, এই পর্যায়ে ভারতীয় জনগণের ওপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে থাকা ফ্যুদতন্ত্রকে ধ্বংস করা হলেও, জাতীয় বুর্জোয়ার সম্পত্তির বাজেয়াপ্তকরণ কোনওমতেই হবে না। এই স্তরে এদের মিত্র হিসাবেই গণ্য করা উচিৎ। জনগনতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ের কাজ দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সুষ্ঠু ও সর্বাঙ্গীণভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর শুরু হবে দ্বিতীয় পর্যায়, যেখানে জাতীয় বুর্জোয়াদের হাতে জমে থাকা সম্পত্তি এবং উৎপাদনের উপকরণসমূহের দখলিকরণ ও সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিপ্লব, যার চরিত্র সমাজতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রথম পর্যায় দ্বিধাহীনভাবেই দীর্ঘস্থায়ী হবে, কারণ বিপ্লবের ফলে তৈরি হওয়া উন্নত উৎপাদন সম্পর্কের ভিত মজবুত করতে উন্নত উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ এক আবশ্যিক শর্ত।
ভারতীয় বিপ্লবের পথ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে স্তালিন ব্যক্ত করেন যে, স্ট্র্যাটেজিক লেভেলে চিনের পথ ভারতে কার্যকরী হলেও, রণকৌশলের দিক থেকে এর চরিত্র কিছুটা ভিন্ন হবে। তিনি বলেন, শুধু কৃষকের পার্টিজান যুদ্ধই নয়, তাকে সংযুক্ত করতে হবে শ্রমিকশ্রেণীর সাধারণ ধর্মঘটের মত কৌশলের সঙ্গেও। কৃষকদের মধ্যে শুধু পার্টিজান ডিটাচমেন্ট তৈরি করে নয়, তাঁদের বোঝাতে হবে যে, শ্রমিকরাও আছেন তাঁদের পাশে, এবং যথেষ্ট অ্যাক্টিভলি। উদাহরণস্বরূপ স্তালিন বলেন, ‘কৃষকদের কথাই ধরুন, আপনারা যদি তাঁদের বলেন, “এটা আপনাদের পার্টিজান যুদ্ধ এবং তা আপনাদেরকেই সামগ্রিকভাবে সম্পন্ন করতে হবে”, তাহলে কৃষকরা জিজ্ঞাসা করবেন, “এই দুর্বহ সংগ্রামের দায়িত্ব কেন একা আমাদের ঘাড়েই পড়বে? শ্রমিকরা তাহলে কী করবেন?” বিপ্লবের সমগ্র ভার তাঁরা একা কাঁধে নিতে চাইবেন না। তাঁরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। তাঁরা জানেন যে, শহরাঞ্চল হল শয়তানের ডেরা..., তাই সেখানে তাঁরা একজন নির্ভরযোগ্য সঙ্গী চাইবেনই।তিনি আরও বলেন, ‘আপনাদের শুধু কৃষকদের মধ্যেই কাজ করলে বা পার্টিজান বাহিনী তৈরি করলে চলবে না, অত্যন্ত গভীরভাবে ও মনোযোগ সহকারে শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যেও কাজ করতে হবে, তাঁদের বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠে তাঁদের অধিকাংশকে জয় করে আনতে হবে। শ্রমিকদের মধ্যেও তৈরি করতে হবে গুপ্ত সশস্ত্র দল, সাধারণ শ্রমিক ও রেল শ্রমিকদের হরতাল সংগঠিত করতে হবে, শহরে শহরে গড়ে তুলতে হবে শ্রমিক বাহিনী। যখন এই দুই ধারার মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হবে, একমাত্র তখনই বিজয়ের সম্ভাবনা নিশ্চিত হয়েছে বলে ধরা যেতে পারে।
চিন বিপ্লব এবং ভারতীয় বিপ্লবের রণকৌশলগত দিকের তফাৎ তুলে ধরে স্তালিন মন্তব্য করেন, চিনে যা সম্ভব হয়েছে তা ভারতে টোটো অনুকরণ করা যাবে না। তাছাড়া নানান কারণে, না চাওয়া স্বত্বেও, মাও-এর সাথে শহরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছিল, নাহলে তিনি যখন নানকিং-এর দিকে রওনা হচ্ছিলেন তখন যদি শাংহাইয়ের মজুররা ধর্মঘট করতেন বা অস্ত্র কারখানায় কাজ বন্ধ করে দিতেন, তাহলে তাঁর সুবিধাই হতো।
এছাড়া স্তালিন তেলেঙ্গানার বিপ্লবী সংগ্রামকে রক্ষা করার কথা বলেন এবং একে চিহ্নিত করেন গৃহযুদ্ধের প্রথম স্ফুলিঙ্গ রূপে। সাথে সাথে তিনি সচেতন করে দেন, যে সমস্ত জায়গায় রেলপথ এবং অন্যান্য যোগাযোগের পথ উন্নত, রিয়ার অনুপস্থিত –সেখানে পার্টিজান সংগ্রাম একা টিকতে পারে না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে স্তালিনের এই সব বক্তব্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া দরকার। দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সাথে এগুলো মিলিয়ে নিতে হবে, এঁচে নিতে হবে প্রতিটা কথা।
রণনীতির দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে যে, ভারতবর্ষের বিপ্লবের অক্ষ চিন বিপ্লবের মতইকৃষিবিপ্লব। তাছাড়া, বিপ্লবপূর্ব চিনের মতই ভারতও একটা আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশ। চিনের মত ভারতীয় বিপ্লবেরও চালিকা শক্তি হশ্রমিকশ্রেণী, কৃষক সমাজ, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এবং পাতিবুর্জোয়ার অন্যান্য অংশ। এর নেতৃত্ব দানকারী শক্তি শ্রমিকশ্রেণী, এবং প্রধান শক্তি সুবিপুল কৃষক জনতা। জাতীয় বুর্জোয়াদের সাথেও প্রয়োজনে ফ্রন্ট গড়ে তোলা দরকার, যদিও ভারতবর্ষে আলাদা করে বড় বুর্জোয়ার মধ্যে জাতীয় বুর্জোয়া অংশ খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন।
এই সব মিল থাকা স্বত্বেও বিপ্লবপূর্ব চিনের সাথে আজকের ভারতের অনেক ফারাক। কৃষি ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের কিছু মাত্রায় বিকাশ, গ্রাম ও শহরের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, শাসকশ্রেণীগুলোর ভেতর দ্বন্দ্বের সামরিক দিকের অনুপস্থিতি, কম্যুনিস্ট পার্টির নিজস্ব সৈন্যবাহিনী না থাকা ও রিয়ারের অনুপস্থিতি, পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার আবেদন ও জনগণের বিপুল অংশের নির্বাচনী মোহ এবং কল-কারখানার অপেক্ষাকৃত জোরাল উপস্থিতি ভারতবর্ষকে বিপ্লবপূর্ব চিনের থেকে অনেকটাই আলাদা করে দিয়েছে। কিন্তু এখনও যেহেতু কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা সর্বাধিক, এবং তাঁরা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের ফাঁসে আটকা পড়ে অসহনীয় নির্যাতন ভোগ করছেন, এবং কর্পোরেট পুঁজির অনুপ্রবেশের ফলে গ্রামীণ প্রোলেতারিয়াতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে হু হু করেতাই দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধ ছাড়া উপায় নেই।
বিপ্লবপূর্ব চিন এবং ভারতের মিল বা অমিলগুলো এই জন্যই আমাদের জানতে হবে, জানতে হবে যাতে দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের পথে যে সব বাধাবিপত্তি রয়েছে তা কাটিয়ে ওঠা যায়। জনযুদ্ধের স্বার্থেই দেশের অসম বিকাশের কথা মনে রেখে পার্লামেন্টবাদের বিরোধিতা করতে হবে সুচিন্তিতভাবে। যে সমস্ত জায়গায় জনতার চেতনার স্তর খুব একটা উন্নত নয়, সেসব স্থানে সংসদ ও নির্বাচন সম্পর্কে মানুষের মোহ কাটিয়ে তুলতে স্থানীয় পঞ্চায়েত বা গ্রামসভার নির্বাচনের সময় প্রচারের সুযোগকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে হবে; যদিয় তা আসনলাভের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে না, পরিচালিত হবে সংসদীয় ব্যবস্থার অসাড়তা সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরে তাঁকে জনযুদ্ধ শামিল করার জন্য। এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থা তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর থেকে উন্নততর হলেও একে কোনোভাবেই বুর্জোয়া পার্লামেন্টের সাথে তুলনা করা যায় না। তাই ভারতের পার্লামেন্টকে বৈপ্লবিক প্রচারমঞ্চ হিসাবে ব্যাবহার করা নেহাত সহজ ব্যাপার নয়। সাম্রাজ্যবাদ সাধারণভাবে সেই সুযোগই দেবে না বিপ্লবীদের। এর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কম্যুনিস্ট পার্টিকেই হজম করে নেবে, পার্টি অধঃপতিত হবে। ভারতের কম্যুনিস্ট আন্দোলনে এমন ঘটনা যে ঘটেছে তা তেলেঙ্গানার অন্যতম নেতা কমরেড পুচিলাপল্লী সুন্দরায়ার ৭৬-এর বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার। সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য যে ইস্তফাপত্র তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিতে দিয়েছিলেন তাতে তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের অনুশীলন ভিত্তি করে আছে এক পার্লামেন্টারি আইনসর্বস্য ইল্যুশনের উপর, যা অনেক গভীরে তার শেকড় চালিয়েছে, এবং এই চিন্তার ওপর যে, আমাদের পার্টি এবং আন্দোলন বিকশিত হবে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায়। অভ্যাসে, চিন্তায় এবং গণফ্রন্টগুলোতে কাজের ধরনে এখনও আমরা সংশোধনবাদকে ঝেড়ে ফেলতে পারি নি।স্তালিনের বক্তব্যের ভিত্তিতে বিপ্লবের পথ নিয়ে ১৯৫১ সালে সিপিআই-তে যে পলিসি স্টেটমেন্ট তৈরি হয়েছিল তার কথা স্মরণ করে সুন্দারায়া ক্ষেদের সাথে এও বলে ওঠেন, ‘…এ ব্যাপারে আমরা সকলেই এক মত যে, আমাদের [বিপ্লবের] পথ ঠিক রাশিয়ার মত বা চিনের মত হবে না, হবে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এক স্বাধীন পথ, যেখানে সম্ভব হলে কৃষকের সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং শিল্পোন্নত ও প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলোতে [শ্রমিকশ্রেণীর] সাধারণ ধর্মঘট ও সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানগুলো একসঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। আমাদের বিপ্লবকে সফল করতে এই দুই প্রধান শক্তিকে সারাভারত পর্যায়ে মেলানো একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু এই জায়গা থেকে, সারাভারতে গণ কর্মসুচী পরিকল্পনার জন্য শ্রমিকশ্রেণী ও কৃষক সমাজকে সর্বভারতীয় স্তরে তৈরি করার নামে ... আমাদের ঠেলে দিচ্ছে সংসদীয় কর্মকাণ্ডের দিকে...’
আগেই বলেছি, বিপ্লবপূর্ব চিনের সাথে আজকের ভারতবর্ষের একটা গুরুত্বপূর্ণ ফারাক এই যে, তৎকালীন চিনের তুলনায় কল-কারখানার দিক দিয়ে ভারতবর্ষ অধিক উন্নত। এখানকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল বুর্জোয়াজী সাম্রাজ্যবাদের সাধারণ দালাল নয়, ছোট শরীক। তাছাড়া, কল-কারখানা বেশী হওয়ার কারণে, এখানে শ্রমিকশ্রেণীর ভল্যুম চিনের চেয়ে অনেক বেশী। ভারতীয় জনগণের একতৃতীয়াংশই বসবাস করেন শহরে। শতাংশের দিক থেকে ভারতের শ্রমিকশ্রেণীর আকার অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশের তুলনায় কম হলেও সংখ্যার দিক থেকে তা বিরাট। এখানে সংগঠিত শ্রমিকদের সংখ্যা নেপালের মত প্রতিবেশী দেশের পূর্ণ জনসংখ্যার বেশী। অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকের সংখ্যা এর চারগুণ। তাই তৎকালীন চিনের চেয়ে আজকের ভারতে বৈপ্লবিক সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণীর অংশগ্রহণের মাত্রা যে পরিমাণগত স্তরে অনেকটাই বেশী হবে, এটা না বললেও চলে।
অবশ্য তাই বলে এটা ভাবার কারণ নেই যে গ্রাম এবং শহরগুলো একসাথেই মুক্ত হবে। শহরের জঙ্গি গণআন্দোলন তখনই অভ্যুত্থানের রূপ পরিগ্রহ করবে যখন বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে গড়ে উঠবে ঘাঁটি এলাকা। তার আগে, শহরের আন্দোলন গ্রামের চলমান পার্টিজান সংগ্রামের সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তা না-হলে বিপুল ক্ষয় ক্ষতির সম্ভাবনা, কেননা শহরগুলো প্রতিক্রিয়াশীলদের ঘাঁটি, এবং এখানে তারা খুব সহজেই নিজেদের বাহিনী কেন্দ্রীভূত করতে পারে এবং সবরকম প্রতিরোধ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে গ্রামীণ ঘাঁটি এলাকার কাছাকাছি যে সমস্ত শহর বা আধা-শহর আছে, সেখানেই অভ্যুত্থান সাধারণভাবে আগে দেখা দেয়। আগে থেকে রাজনৈতিক কাজ থাকলেও এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হয়।
এখন প্রশ্ন হ, শহরের জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন গ্রামাঞ্চলে কৃষকের পার্টিজান লড়াইয়ের সহায়ক শক্তি রূপে কাজ করবে কিভাবে? দেখা যাক...
নিজস্ব সৈন্যবাহিনী না থাকা বা রিয়ারের অনুপস্থিতি স্বত্বেও কৃষকের দীর্ঘস্থায়ী পার্টিজান লরাই-ই আমাদের বিপ্লবের পথ, অন্যান্য আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশের মতই। কিন্তু তাতেও তো বেশ কিছু প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টরের অস্তিত্ব কাম্য। চিন বিপ্লবের সময় গণবাহিনী যখন মাঞ্চুরিয়াতে পৌঁছোয় এবং সোভিয়েতকে রিয়ার হিসাবে পায় তখনই তার জয় সুনিশ্চিত হয়। তা ছাড়া তৎকালীন চিনের যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে শত্রু বাহিনীকে সৈন্য সংহত করতে বেগ দিয়েছিল। ভারতে অবস্থা ভিন্ন। জনগণই প্রকৃত লৌহ প্রাকার’ –এই শিক্ষার ভিত্তিতে, অর্থাৎ জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক কাজের মাধ্যমে তাঁদের চেতনার স্তরকে উন্নত করে প্রাথমিকভাবে গেরিলা জোনগুলো গড়ে উঠবে এবং ক্রমে ঘাঁটি এলাকার রূপ নেবে। কিন্তু দেশের বিরাট এলাকা জুড়ে পার্টিজান সংগ্রামের অগ্রগতির ফলে যখন স্থানীয় নিপীড়নকারী যন্ত্রগুলো অচল ও অকেজো হয়ে পড়বে, তখনই কম্যুনিস্ট বিপ্লবীদের পড়তে হবে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত শত্রুবাহিনীর চূড়ান্ত ঘারাও-দমনের মধ্যে। এই পরিস্থিতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা নেবে শ্রমিকশ্রেণী। পার্টির শক্তিসমুহ এবং গ্রামীণ ঘাঁটি এলাকাগুলোর ওপর শত্রু বাহিনী যখন আক্রমণ নামিয়ে আনতে চেষ্টা করবে, তখন শ্রমিকশ্রেণীকে ব্যাপক গণসংগ্রামের দ্বারা তাকে বাধা দিতে হবে। এই গণসংগ্রামকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে চেষ্টা করবে রাষ্ট্রীয় জল্লাদরা। কিন্তু পারবে না, এই গণআন্দোলনগুলোই প্রতিরোধী চরিত্র ধারণ ক’রে রূপ নেবে গণঅভ্যুত্থানের।
যাইহোক, একটা ব্যাপার বেশ পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে, স্তালিন যেভাবে ভারতীয় বিপ্লবের পথকে দেখেছিলেন, অর্থাৎ রণকৌশলের দিক থেকে শহরের আন্দোলন এবং গ্রামের সংগ্রাম একসাথেই বিকশিত হবে, তা অসম বিকাশযুক্ত এই বিরাট দেশে সম্ভব নয়। শ্রমিকশ্রেণীকে সংগঠিত না করে কোনও বিপ্লব সাফল্য পেতে পারে না, কিন্তু নিতান্ত বস্তুগত কারণেই এখানে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রথম স্তরে গ্রাম ও শহরের আন্দোলন সাইমাল্টেনাসলী বিকশিত হওয়া সম্ভব নয়।
তবে, রাজনৈতিক কাজের ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব দিতে হবে শহরে ও গ্রামে। পার্টিজান সংগ্রাম পরিচালনা করবো ব’লে শহরের শ্রমিকশ্রেণীকে পরে রাজনীতি দেবো, এমন মানসিকতা আন্দোলনের ক্ষতি ক’রে। আমাদের মনে রাখতে হবে, কৃষকের পার্টিজান সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যুগের দাবী। অতএব, শহরে প্রাথমিকভাবে একজন শ্রমিককে নানান গণআন্দোলনের মধ্যে দিয়ে প্রস্তুত করতে হবে যাতে সে গ্রামে গিয়ে পার্টিজান যুদ্ধের নেতৃত্বের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারে। সেখানে ঘাঁটি এলাকা তৈরি হলে তবেই শহরগুলোতে অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি তৈরি হবে। তাই আজও ভারতীয় বিপ্লবের পথ হল শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে দীর্ঘস্থায়ী পার্টিজান যুদ্ধের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে ঘাঁটি এলাকা তৈরি করে শহরগুলকে ঘিরে ফেলা ও পরিশেষে সেখানে শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা।
কমরেড স্তালিন যে বক্তব্য রেখেছিলেন তার থেকে আমাদের একটা বিশেষ ব্যাপার শিখতে হবেঃ দিকে দিকে তেলেঙ্গানা তৈরির স্লোগান যখন দিয়েছিল সিপিআই, বা যখন সিপিআই (এম-এল)-এর বিপ্লবীরা নকশালবাড়ির পথে নিয়েছিলেন পার্টিজান যুদ্ধের কৌশল, তখন শ্রমিক আন্দোলনের ওপর মৌখিক জোর দেওয়া স্বত্বেও তা কাজে পরিণত হয় নি, সমান গুরুত্ব আরোপ করা হয় নি। এমন একটা অবস্থা দুইক্ষেত্রেই তৈরি হয়েছিল যে শ্রমিক আন্দোলনগুলোতে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা মানুষগুলো নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। লড়াইগুলো হারিয়ে গেছিল অর্থনীতিবাদের চোরাবালিতে।
সে দিনগুলোর থেকে আজকের পরিস্থিতি অনেক বেশী জটিল। আজকে শ্রমিকশ্রেণীকে বাদ দিয়ে যারা জঙ্গল বা পাহাড়ের কোনায় লুকিয়ে গেরিলা সংগ্রাম চালাচ্ছেন তাঁরা বেসিক মাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন, এমনকি সমতলের কৃষক সমাজ থেকেও বিচ্ছিন্নতা দেখা দিচ্ছে। বেসিক জনগণের প্রধান দুই অংশের ওপর সমান জোর না দিলে কোনও সংগ্রাম শেষ অবধি জয়যুক্ত হয় না। নিজেদের কর্মপদ্ধতি না পালটালে আজকের বিপ্লবীরাও আগের মতই হারিয়ে যাবেন, স্বপ্নের পাখিগুলো আবার মরে যাবে। তাই আবার করে আমাদের শেখা দরকার, দেশের বাস্তব পরিস্থিতির সাথে মিলিয়ে নেওয়া দরকার ’৫১ সালের শিক্ষাকে।

2 comments:

  1. তথ্যসূত্র ও টিকা দিলে ভালো হয়। মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। কোনো একসময় কথা বলা যাবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. http://www.revolutionarydemocracy.org/rdv12n2/cpi2.htm

      Delete