Man's dearest possession is life. It is given to him but once, and he must live it so as to feel no torturing regrets for wasted years, never know the burning shame of a mean and petty past; so live that, dying he might say: all my life, all my strength were given to the finest cause in all the world- the fight for the Liberation of Mankind. - Nikolai Ostrovsky

Sunday, March 31, 2013

ক্রুসো থেকে ‘কম্যুনিজম’ (বঙ্গীয়) – একটি টেলিওলজিক্যাল পরিণতি (অপ্রকাশিত)

এত আদর্শ থাকতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি কেন বামপন্থী ভাবাদর্শে বিশ্বাসী—এ নিয়ে বোদ্ধা সমাজে একাধিক সন্দর্ভের সন্ধান মেলে। কেউ একে বলেন শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রভাব প্রসূত, কেউ বা প্রথম চর্যাকার লুইপার। (লুই-কে নিয়ে অবশ্য সাবল্টার্ন স্টাডিজের লোকেরা বেশী মাতামাতি করেন, ‘ফিশ গাট ইটার’ বলে কথা!) তবে কারোর মতকেই চূড়ান্ত বলা চলে না। ‘এ’ একটা কারণ দেখালে ‘ও’ দশটা দেখায়; আবার ‘সে’ এসে দুজনকেই নস্যাৎ করে দেয়, গুচ্ছ রেফারেন্স সহযোগে প্রমাণ করার চেষ্টা করে— সে একাই হনু, বাকিরা উচ্চৈঃশ্রবাঃর ‘ইয়ে’ মাত্র।
বলা বাহুল্য, এসব উচ্চমার্গের ডিসকোর্স আমি বুঝি না। ভাত, ডাল, ঝোল, অম্বল গেলা ‘পাতি’ অশিক্ষিত বাঙালী আমি, কাঠ খেলে স্বাভাবিকভাবেই আংরা হাগি। এবং এই শিক্ষাদীক্ষাহীন, ‘পাতি’, পেটরোগা গুণাবলীর কারণেই বোদ্ধাদের প্রবলেমটা আইডেন্টিফাই করতে পারি— গুচ্ছ পুঁথি পড়ে ওঁদের ক্রিয়েটিভ চিন্তার দফারফা হয়ে গেছে। আসলে যে এখানে ‘বাম’ ও ‘ডান’-কে আলাদা করা বাতুলতা মাত্র, এটাই ওঁরা বোঝেন না। প্রশ্নটা হবে সিধা ও সাপটা: বাজারে এত দল থাকতে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত বাঙালী হঠাৎ সি,পি,আই, (এম)-এর মতো একটা দলের গুণগ্রাহী কেন? (ইয়ার্কি নয়, এটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। এই নিয়ে দেরিদা কাটিং ক্রিপটিক ভাষায় একটা ঝক্কাস পেপার লিখে ফেলতে পারলেই পিএইচ,ডি,।) উত্তরটা সহজ, তবে সরল নয়। এর সাথে মিশে আছে ইতিহাস, সাহিত্য এবং মার্কসের ‘ডবল মিশন’ থিসিসের সীমাবদ্ধতা; অনেকটা ‘চন্দ্রবিন্দুর চ, বিড়ালের ‘তলব্য শ’, রুমালের মা’-র মতো!
ইতিহাস দিয়েই শুরু করা যাক। আচ্ছা, বলুন তো, ভারত তথা বাংলার বুকে ‘বণিকের মানদণ্ড’ কবে ‘রাজদণ্ড’ হয়ে দেখা দিল? ইজি আনসার— ২৩এ জুন, ১৭৫৭, ভেনু: পলাশীর আম বাগান। আচ্ছা, এবার বলুন দেখি, ‘অ্যাডাম’স রিপোর্ট’-এর প্রতিপাদ্য বিষয় কী ছিল? (ইয়ে, মানে এটা নট সো ইজি!) পারলেন না তো! ‘অ্যাডাম’স রিপোর্ট’-এর মূল বক্তব্য ছিল এই যে, ইন্ডিজেনাস এডুকেশনের পোঙা মেরে বিলিতি শিক্ষা না চাপালে এ দেশের ‘জেনেগেণ’-কে তাঁবে আনা যাবে না। রিপোর্ট পেয়েই সায়েবরা তৎপর হয়ে উঠেছিলেন— মেকলে থেকে বেথুন, সে এক এলাহি কাণ্ড! বেথুন সায়েব তো ছাত্রদের জামা খুলে গামছা দিয়ে ডলে ডলে গা-ও মুছিয়ে দিতেন বলে শোনা যায়! (না, না! আমি অবশ্য কোনও খারাপ ইঙ্গিত করছি না; তবে দুষ্টুলোকে বলে, ইটন ইশকুলে ছাত্রদের মধ্যে নাকি কী—সব ‘অসভ্য’ প্রথা চালু ছিল... আমার জানা নেই বেথুন সেখানে পড়তেন কিনা।)
যাকগে, এবারে সেকেন্ড কোয়েসচেন। ইতিহাসের স্তূপ সরিয়ে বরং আসা যাক সাহিত্যের উঠনে, থুড়ি, আঙিনায়। উইকি না করে বলুন দিকি প্রথম ইংরাজি উপন্যাসের নাম? ১০০’র মধ্যে ৭০ জন কোরাসে বলবেন, ‘দ্যা লাইফ অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার্স অব রবিনসন ক্রুসো’। ইশকুলে র‍্যাপিড রিডার ছিল, এম,এ, ক্লাসে ব্রিটিশ নভেলের অন্যতম পাঠ্যও ছিল...। ১৭১৯ সালে লেখা এই উপন্যাসের ব্যাপারই আলাদা, লেখক এক দেউলে সাংবাদিক, নাম ড্যানিয়েল ডিফো। বইয়ের শুরুর দিকে প্রোটাগনিস্ট জানাচ্ছেন, তাঁর প্রাজ্ঞ বাপ তাঁকে কিছু সুচিন্তিত পরামর্শ দিয়েছেন, যথা— ‘উত্তম’ বা অধম হওয়ার থেকে ‘পুলু’ হওয়া ঢের বেশী লাভজনক; সামাজের জন্য কিছু করতে হবে,—এই চিন্তার বোঝা নেই, না খেতে পেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে, —এমন দারিদ্র্যের সাজাও নেই; তাই ‘দ্যা মিডল অব দ্যা ট্যু এক্সট্রিমজ’—‘যে জন আছে মাঝখানে’—হয়ে থাকো, পায়ের ওপর পা তুলে তোফা কাটিয়ে দিতে পারবে পুরো জীবন।
বাঙালির রোম্যান্টিক অথচ প্যাসিভ মননের উৎস এখানেই। ‘দাই হ্যান্ড গ্রেট অ্যানার্ক'-এ নীরদ চৌধুরী লিখছেন, উনিশ শতকের শেষ ধাপে শিক্ষিত বাঙালির জীবনে সাহিত্য মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল, গড়ে দিয়েছিল তাদের নীতিবোধ এবং মতাদর্শের ভিত্তি, এমনকি সেন্টিমেন্ট ও আবেগ অবধি! কে জানে, হয়ত বাঙালি সেই কারণেই পূর্বোক্ত ইংরাজি উপন্যাসের শুরুতে দেওয়া বাপ ক্রুসোর নীতি শিক্ষার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারে নি (বাপের মুখে মুখে তক্ক করা দূরে থাক বাঙালি ছেলেরা সে-যুগে বাপের সামনে সামান্য গলা তুলে কথাও কইত না)। আবার একই সাথে সে রবিনসনের নির্ভীক জাহাজি জীবন, মানুষখেকো ঠেঙিয়ে কলোনি স্থাপন ইত্যাদি সম্পর্কেও আকর্ষণ বোধ করেছিল। কিন্তু এ দু’য়ের মিশেল হবে ক্যামনে? এই ডাইকোটমির শেষ কোথায়!... ভেবে ভেবে হয়ত তার অগ্নিমান্দ্যও হয়েছিল। অথচ উপায়ন্তর ছিল না। স্ট্রাটেজিতে গড়বড় থাকায় ট্যাক্টিকাল একজিক্যুশন ঘেঁটে গেছিল, ব্রহ্মচর্যের সংকল্প নিয়ে চলেছিল আত্মরতি। অস্বস্তির চরম...।
১৮৫৩ সালে ‘ন্যুইয়র্ক ডেইলি ট্রিব্যুন’-এ মার্কস লিখেছিলেন, ভারতীয়দের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার নিজের কবর নিজেই খুঁড়ছে। ডিফোর লেখা পড়লেও মার্কস সম্ভবত অ্যাডাম’স রিপোর্ট পড়েন নি, তাই বুঝতে পারেন নি, তাঁর ওই ভবিষ্যৎবাণী ফলবতী হবে না। ১৯ শতকের শেষ পাদে যখন এই উপমহাদেশে কৃষক বিদ্রোহের তুফান উঠছিল, সেই ১৮৮২ সালে, এঙ্গেলস কাউটস্কিকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ভারত হয়ত নিশ্চিতভাবেই এক সামাজিক বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। হ্যাঁ, সরকার বাহাদুরও চিন্তায় ছিলেন, এই বুঝি চাষারা দিল ঝেড়ে! এমন সময়ই ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন হিউম। তাঁর ডাইরি থেকে জানা যায়, লর্ড ডাফরিনের আদেশে তিনি ইংরাজি শিক্ষায় পারদর্শী ভারতীয় পাতিবুর্জোয়াদের নিয়ে সামাজিক বিপ্লবের সেফটি ভাল্ব হিসাবে ১৮৮৫ সালে গড়ে তুলেছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। এরও আগে, ১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহের যুগে, ইংরাজি কেতাব পড়া শিক্ষিত বাঙালি, ভায়োলেন্সকে গোমাংসবৎ জ্ঞান করে, নিজেকে সংস্কারমূলক আন্দোলনের সীমায় আবদ্ধ রেখেছিল। ’৫৮ সালে ‘দ্যা হিন্দু পেট্রিয়ট’-এর পাতায় লেখা হয়েছিল— যুদ্ধে বাহিনী পরিচালনার গৌরব লাভ করতে বাঙালি মোটেও লালায়িত নয়।... তাদের উদ্দেশ্য এবং বিজয় একান্তই অসামরিক ধরনের। A strong and versatile intellect enables them to think deeply and to think farsightedly… They are in hopes that by lawful and constitutional appeals to the good sense and justice of the English people sitting by the representatives in a sovereign Council or Parliament, they, when the fitting moment arrives, will rise yet further in the scale of equality with their foreign rulers and divide with them the honour and the responsibility of administering the affairs of the largest and the most well established empire in Asia.’ শিক্ষিত বাঙালি সেদিন সামান্যতম সমর্থনও করে নি মহাবিদ্রোহকে। বিরোধিতাই করেছিল। নীল বিদ্রোহের আগে ইংরেজ কুঠিমালিকদের লালসাযূপে যখন বাংলার কৃষক সমাজের রক্ত ঝরেছে তখনও রামমোহনদের বাটিতে সায়েব-মেমদের মোচ্ছবের আসর বসছে, ‘নিকি—দ্যা নচ গার্ল’-এর শরীরী বিভঙ্গে ‘গোরে সাব’ টু ‘ভুরে সাব’ সবাই কাত! ... ... ...
শিক্ষিত বাঙালির মাথায় ইংরেজ সযত্নে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ‘দ্যা মিডল অব দ্যা ট্যু এক্সট্রিমজ’-এর ভাবাদর্শ। ১৭১৯ সালে লেখা প্রথম ইংরাজি উপন্যাসের একটি তথাকথিত অকিঞ্চিৎকর অংশ হয়ত এভাবেই গোটা বাঙালি মননকে গড়ে দিয়েছিল, গড়ে দিয়েছিল আগামী প্রজন্মগুলোকেও। ফলস্বরূপ, মার্কসের আশা বাস্তব রূপ পায় নি, শিক্ষিত ‘পাতি’ বাঙালি চার কলম ইংরাজি শিখে ‘এন্টায়ারলী সিভিল’ ‘ট্রায়াম্ফ’ নিয়ে খুশী থেকেছে, কলম পিষেছে এখানে-ওখানে, রাত্রে জয়ন্ত-মানিক বা বিমল-কুমারদের সাথে কল্পনায় ঘুরে বেরিয়েছে আফ্রিকা, ময়নামতির মায়াকানন, মায় মঙ্গলগ্রহ।
কোনও রিস্ক নিতে না চাওয়া, অথচ সোশ্যাল রিভোল্যুশনারীর সম্মান পাওয়ার ইচ্ছা, —এই অসম্ভবের মেলবন্ধনই শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত বাঙালিকে সি,পি,আই, (এম)-মুখী করেছে, মানসিকভাবে গ্রহণ করতে সাহায্য করেছে এর লাইন। ‘প্রেস্টিজ অব দ্যা লেফট’ এবং ‘প্রিভিলেজ অব দ্যা রাইট’, —এই দু’য়ের রিয়ালাইজেশনের জায়গা এই দল। এর সাথে লেপটে থাকলে সামাজিকভাবে বিপ্লবীর স্টেটাস পাওয়া যায়, আবার সেই সাথে সামাজিক সুযোগ-সুবিধাগুলোও মেলে। সি,পি,আই, (এম) একেবারে বাঙালি পার্টি, এর শেষে ‘আই’ থাকলেও আদতে ওটা ‘বি’, ‘বি ফর বেঙ্গল’। তা নাহলে রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগ পাওয়ার জন্য লালায়িত হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা কমিটির আনা সংশোধনী (‘ভারত রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছে শাসক শ্রেণীগুলি’)-র সমালোচনা করে বলতে হয়— ‘ভারত রাষ্ট্র হল শ্রেণী শোষণের যন্ত্রবিশেষ’? মাথা-মুখ-হাত। মধ্যশ্রেণীভুক্ত শিক্ষিত বাঙালি তথা সি,পি,আই, (এম)-র কাছে এর সরলরৈখিক উপস্থিতি চিন্তার অতীত।
তবে ইতিহাস প্রমাণ করেছে, মধ্যশ্রেণীর এই আচরণে বৈপ্লবিক সম্ভাবনার গর্ভপাত ঘটলে এক বিশেষ মতাদর্শের দরজা উন্মুক্ত হয় যার নাম ফ্যাসিবাদ। অবশ্য তাতে শিক্ষিত বাঙালির কিই বা আসে যায়—স্বভাব যায় না মলে, ইল্লত যায় না ধুলে! তারা সভা-সমিতি-ফেসবুক ইত্যাদি করবেন, পাতার পর পাতা লিখবেন... কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার দণ্ডকারণ্যে এক লাখ সিআরপি নামালে চুপ থাকবেন। চুপ থাকতে হয়, নাহলে পিছিয়ে পড়তে হয়! 

4 comments:

  1. I agrre. 'ইয়ার্কি নয়, এটা গবেষণার বিষয় হতে পারে।'

    ReplyDelete
  2. ইয়ে ... মানে গাঁড় মেরে দিলে যে :(

    ReplyDelete
  3. Thk e. Jabotio dwicharitar milon. Sejnyoi poroborti party line thk korar smy o suchintito modhyopontha

    ReplyDelete