Man's dearest possession is life. It is given to him but once, and he must live it so as to feel no torturing regrets for wasted years, never know the burning shame of a mean and petty past; so live that, dying he might say: all my life, all my strength were given to the finest cause in all the world- the fight for the Liberation of Mankind. - Nikolai Ostrovsky

Monday, June 25, 2012

কালপুরুষ - বাসু আচার্য (এবং জলার্ক, চারু মজুমদার সংখ্যা ৭)




২৩-এ মার্চ, ২০১০। বেলা ১২টা নাগাদ সর্বত্র খবর ছড়িয়ে পড়ল, নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও নেতা কমরেড কানু সান্যাল প্রয়াত হয়েছেন। সাধারণ মানুষ স্তম্ভিত হয়ে শুনল— বার্ধক্যজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে নয়, মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা। যিনি প্রান্তিক মানুষের লড়াইয়ের নেতা, একজন কম্যুনিস্ট, তিনি কেন আত্মহননের পথ বেঁছে নেবেন? হ্যাঁ, ভীষণভাবেই অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু তাই বলে লড়বেন না শেষ অবধি? আপামর জনসাধারণ বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কিছু মানুষ মনকে প্রবোধ দিচ্ছিলেন পল লাফার্জের শেষ চিঠির কথা ভেবে, যা লেখার পর ধমনীতে তিনি সূক্ষ্ম ইনজেকশন-এর সাহায্যে প্রবেশ করিয়েছিলেন সায়ানাইড অ্যাসিড। কিন্তু বিপ্লবী থেকে রাজনীতির মারপ্যাঁচ না-বোঝা সাধারণ মানুষ, কেউই মানতে পারছিলেন না এভাবে শেষ হয়ে যাওয়া। এমনভাবে নাও তো হতে পারতো যুগাবসান। ...
১৯২৯ সালে দার্জিলিং-এর অন্তর্গত কার্শিয়ং-এ জন্ম হয় কানু সান্যালের (তাঁর স্কুলের রেকর্ডে অবশ্য বলা আছে, তাঁর জন্ম ১৯৩০-এর ১০-ই জুলাই)অন্নদাগোবিন্দ সান্যাল ও নির্মলা সান্যালের সাত পুত্র ও কন্যা সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। যতদূর জানা যায়, ছোট থেকেই কানু সান্যাল ছিলেন কষ্ট সহিষ্ণু ও কর্মতৎপর। তাঁর অন্যতম সুহৃদ শ্রী সুবোধ মিত্র মনে করেন, সম্ভবত পাহাড়িয়া মানুষের কাছাকাছি থাকার ফলেই তাঁর এই গুণগুলো বিকশিত হয়েছিল। জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজে ইন্টারমিডিয়েট-এর ছাত্র থাকাকালীন তিনি রাজনীতি সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন ও ক্রমশ কম্যুনিস্ট মতাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হন। কিছু দিন পর বেআইনি পার্টির ছাত্র শাখায় কাজ শুরু করেনতবে খুব বেশী দিন এই ছাত্রাবস্থা স্থায়ী হয় নি। আর্থিক অনটনের কারণে পড়াশুনা বন্ধ করে জলপাইগুড়ির মহকুমা শাসকের অধীনে রাজ্য সরকারের ল্যান্ড সেটেলমেন্ট দপ্তরে চাকরী নিতে বাধ্য হন তিনি। সেই সময় বিধান রায়ের কংগ্রেস সরকার কলকাতার রাজপথে শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর গুলি চালিয়ে চারজন মহিলা কম্যুনিস্ট বিপ্লবী—লতিকা সেন (দাস), প্রতিভা গাঙ্গুলি, অমিয়া দত্ত এবং বকুল সরকার-কে খুন করে। এর প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ কালো পতাকা প্রদর্শন মিছিলে অংশ নিয়ে গ্রেফতার হন কানু সান্যালজেলে তাঁর সাথে পরিচয় হয় উত্তর বাংলার তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা চারু মজুমদারের। এই পরিচয় ক্রমশ ঘনিষ্ঠতার রূপ নেয়। কানু সান্যালকে তিনি মতাদর্শগতভাবে শিক্ষিত করে তোলেন।
জেল থেকে বেরিয়ে ১৯৫০ সালে অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন কানু সান্যাল। ১৯৫২ সালের এপ্রিল মাসে তিনি পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে দার্জিলিং জেলার গ্রামে কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করেন। তরাই এলাকার চা শ্রমিক এবং দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের অন্যতম প্রধান সংগঠক হয়ে ওঠেন তিনি, কাজ করতে থাকেন তরাই কিষাণ সমিতির নামে। এই সমিতির নেতৃত্বে জঙ্গি জমি দখল আন্দোলন সংগঠিত হয়। ১৯৫৩ সালে আমবাড়ি সম্মেলন থেকে তিনি শিলিগুড়ি মহকুমা কৃষক সমিতির সম্পাদক হন এবং কেরালার মালাবারের অন্তর্গত কান্নানোরে অনুষ্ঠিত সারাভারত কিষাণ সভার সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে তিনি দার্জিলিং জেলা কৃষক সভার সম্পাদক নির্বাচিত হন, ও এর এক বছর পর প্রাদেশিক কৃষক সভার কাউন্সিলের সদস্যপদ পান।
১৯৬২ সালে চিন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে ‘ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া রুল’-এ গ্রেপ্তার হন কানু সান্যাল। ’৬৪-র প্রথম দিকে ছাড়া পেয়ে পার্টির জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতে আসেন। ঐ বছরই দীর্ঘ মতাদর্শগত সংগ্রামের পরিণতিতে পার্টি ভাগ হয়ে গেলে তিনি অপেক্ষাকৃত বিপ্লবী অংশ সিপিআই (এম)-এ যোগ দেন। কিন্তু এই সংগ্রামের ফল আত্মসাৎ করে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা মধ্যপন্থী নেতারা। অচিরেই কানু সান্যাল-সহ আরও অনেকে বুঝতে পারেন যে, সিপিএম নেতৃত্ব মুখে বিপ্লবের কথা বললেও আসলে দক্ষিণপন্থী সিপিআই নেতৃত্বের সাথে তাদের কোনও তফাৎ নেই। ডাঙ্গেপন্থীরা যেমন খোলাখুলিভাবে শাসক শ্রেণীর লেজুড়বৃত্তি করে, সিপিএম নেতৃত্ব তেমনটা না করলেও, আড়ালে আবডালে একই রাজনীতির উপাসক। তফাৎ এইটুকুই যে, সংশোধনবাদের এই নবতম অবতার সংগ্রামে একটু আদার ঝাঁঝ আনার চেষ্টা করে যাতে কর্মীবাহিনীকে ভুলিয়ে রাখা যায়।
এই নয়াসংশোধনবাদী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সারা দেশজুড়ে অসংখ্য কম্যুনিস্ট নেতা-কর্মী সোচ্চার হয়ে ওঠেন। কিন্তু সংশোধনবাদী বা নয়াসংশোধনবাদী কর্মপন্থার বিপরীতে বিপ্লবী কর্মপন্থা কী হবে তা তাঁরা ঠিক করে উঠতে পারছিলেন না। সেই সময়েই তাঁর ঐতিহাসিক আট দলিল নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন চারু মজুমদার। ১৯৬৫-র ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৬৭-র এপ্রিলের মধ্যে তিনি যে সব দলিল রচনা করেন, তাতে মিউনিসিপালাইজেশনের রোগে আক্রান্ত নেতাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে তিনি তুলে ধরেন মহান মাও সেতুং নির্দেশিত সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের রণনীতি ও কৌশল। তাঁর এইসব দলিলের মাধ্যমে চারু মজুমদার ভারতীয় বিপ্লবের ঐতিহাসিক সমস্যাগুলো সমাধান করেন। তিনি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেন—(১) তথাকথিত শান্তিপূর্ণ পথে নয়, সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রামের পথেই একমাত্র বিপ্লব সম্ভব; (২) মাও নির্দেশিত গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার রণনীতিই হল ভারতের প্রকৃত বিপ্লবী নীতি; (৩) কৃষক জনগণকে বাদ দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের লাইন নেয়ার অর্থ পাতি বুর্জোয়া বিচ্যুতি বই কিছু নয়
কানু সান্যাল এসে যোগ দেন চারু মজুমদারের সাথে। চারু মজুমদারের পরেই উঠে আসতে থাকে তাঁর নামসৌরেন বসু, শান্তি পাল, পবিত্র সেনগুপ্ত প্রমুখরা আট দলিলের রাজনীতিকে নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি, ফাঁসিদেয়া, ইত্যাদি অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচারে নিয়ে যান। কৃষকের ইজ্জৎবোধ জাগ্রত হয়। তাঁরা বুঝতে পারেন লড়াইটা নিছক জমির নয়, হুকুমতের!
চারু মজুমদার রচিত দলিল নিয়ে চিনের পথে পায়ে হেঁটে যাত্রা করেন এক নেপালি কৃষক কমরেড, নাম কৃষ্ণভক্ত শর্মা। বহু কষ্ট ও পরিশ্রম সহ্য করে তিনি সেগুলো পৌঁছে দেন চিনা কম্যুনিস্টদের কাছে।
আট দলিলের আঁচ গিয়ে পড়ে কৃষক সমিতির মহকুমা সম্মেলনের উপর, গৃহীত হয় সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের লাইনসভার মঞ্চ থেকে জোতদার-জমিদারদের ক্ষমতা শেষ হওয়ার কথা ঘোষণা করেন কানু সান্যাল। হাজার হাজার কৃষক জনতার সামনে বজ্রকঠিন কণ্ঠে বলে ওঠেন—‘কাল থেকে জমিদারী, জোতদারী উচ্ছেদ হয়ে গেল এই এলাকায়; কাল থেকে লাঙলের ফলার দাগ দিয়ে জমির নতুন সীমানা তৈরি করে জমি বিলি করবে মহকুমা কৃষক সমিতি।’ বিপুল কৃষক জনতা এতদিনের গোলামির যন্ত্রণা থেকে যেন মুক্তি লাভ করেন। ঘরোয়া অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাঁরা জোতদার-জমিদারদের জমি-জিরেত ও অন্যান্য সম্পত্তির দখল নিতে শুরু করেন
ইতিমধ্যে কংগ্রেস-কে হারিয়ে ভোটে জয়ী হয়েছে সিপিএম-বাংলা কংগ্রেস-সহ ১৪-পার্টির জোট। কৃষক বিদ্রোহের আগুনকে নিভিয়ে দিতে ১৭-ই মে যুক্তফ্রন্ট সরকারের ভূমি ও ভূমিরাজস্বমন্ত্রী ও সিপিএম নেতা হরেকৃষ্ণ কোনার বিপ্লবী কম্যুনিস্টদের সাথে আলোচনা করতে আসেন। সুকনা ফরেস্ট কোয়ার্টারে তাঁর সাথে আলোচনা হয় কানু সান্যাল ও সৌরেন বসুর। মন্ত্রীর দেওয়া আত্মসমর্পণের ঘৃণ্য প্রস্তাব তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেন। পর-দিন খোলা মিটিং থেকে হরেকৃষ্ণ কোনার বিপ্লবীদের নামে নানা ধরনের গালিগালাজ করেন। তিনি ফিরে গেলে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে পুলিশ। এমনই এক সময় ভাগচাষী বিগুল কিষাণ ও বাংলা কংগ্রেস নেতা আধা-মন্ত্রী ঈশ্বর তির্কের ভেতর জমি চাষের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে বচসা হয় ও লেঠেল বাহিনী দিয়ে ঠেঙিয়ে বিগুলের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। কৃষকরা এবার বিদ্রোহে ফেটে পড়েন। ২৪-এ মে গ্রামে পুলিশ ঢুকলে চা শ্রমিক ও কৃষকের তীরের আঘাতে খতম হয়ে যায় ইন্সপেক্টর সোনাম ওয়াংদি। পরের দিন যুক্তফ্রন্টের পুলিশবাহিনী নকশালবাড়ির বড়ঝাড়ুতে ঢুকে প্রসাদজোতে দুজন শিশুসহ ১৩-কে হত্যা করে। মৃতেরা অধিকাংশই ছিলেন মহিলা। কৃষকরা এবার ফুঁসে ওঠেন। আগামী তিন মাস এলাকায় পুলিশের ঢোকা বা বসবাস করা বন্ধ হয়ে যায়। জনতার প্রশাসন তৈরি হয়, দায়িত্বে বিপ্লবী কৃষক নেতৃত্ব। চিনের কম্যুনিস্ট পার্টি এই মহান কৃষক সংগ্রামকে সমর্থন করে লেখেন—‘ভারতের বুকে বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ’। পিঠ বাঁচাতে সিপিএম নেতারা বলেন, ‘সব সিআইএর চক্রান্ত।’
নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের অনতিকাল পরেই চারু মজুমদারের পরিকল্পনা অনুযায়ী কানু সান্যাল ও সৌরেন বসু নকশালবাড়ির বীর সংগঠকদের দুটি দল নিয়ে চিন অভিমুখে যাত্রা করেন। সেখানে তাঁরা মাও সেতুং-সহ অন্যান্য চিনা নেতাদের সাথে আলাপ আলোচনা চালান ও মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও চিন্তাধারা শিক্ষা করেন, হাতে কলমে শিক্ষা করেন গেরিলা যুদ্ধের বিবিধ পদ্ধতিকানু সান্যালরা চিন থেকে ফিরে আসার সময় (ডিসেম্বর ১৯৬৭) মাও সেতুং তাঁদের বলেন নিজের দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী মার্কসবাদী-লেনিনবাদী শিক্ষার প্রয়োগ করতে। চিনের অন্ধ অনুকরণ করতে তিনি নিষেধ করেন, বলেন—‘এখানে যা শিখলে সব ভুলে যেও’দেশে ফিরে নানা কারণে হয়ত এ-কথা বিস্মৃত হন কানু সান্যালআর তার ফলেই ঘটে মিরিক পাহাড় অভিযান। চিনে থাকাকালীন মাও-এর চিংকাং পাহাড় সংক্রান্ত রচনা পাঠ করেন ভারতীয় বিপ্লবীরা। সেই চিংকাং মডেলকে অন্ধ অনুকরণ করে কানু সান্যাল মিরিক পাহাড় অভিযানের লাইন উপস্থিত করেন। প্রায় ১০০ কৃষক ও সংগঠককে নিয়ে তিনি মিরিক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং স্বাভাবিকভাবেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অত্যন্ত হাস্যকরভাবে এই অভিযানের পরিসমাপ্তি ঘটে।
ওদিকে সারা ভারতের বিপ্লবীরা নকশালবাড়ির পাশে সমবেত হন। নয়াসংশোধনবাদী নেতৃত্ব বেগতিক বুঝে একে একে চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, সৌরেন বসু প্রভৃতিকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করে। বহিষ্কার করা হয় এই সংগ্রামের সমর্থনে অন্যান্য জায়গায় যারা প্রচার চালাচ্ছিলেন, সেই সরোজ দত্ত, সুশীতল রায় চৌধুরী, অসিত সেন, প্রমুখদেরও। ১৯৬৭-র ১১-ই নভেম্বর কলকাতা শহীদ মিনার ময়দানে সারা দেশের কম্যুনিস্ট বিপ্লবীরা এক প্রকাশ্য সভায় মিলিত হন। চারু মজুমদার-কে মিটিং-এ বলতে বলা হলে তিনি বিপুল জনতার সামনে এসে বলে ওঠেন—‘আমি বক্তৃতা করতে পারব না, আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি জানি আপনারা আমাকে নকশালবাড়ির নেতা মনে করেন। আমার কাছ থেকে নকশালবাড়ি সম্পর্কে জানতে চানকিন্তু আমি তো নকশালবাড়ির নেতা নই। নকশালবাড়ির নেতা কমরেড কানু সান্যাল, কমরেড জঙ্গল সাঁওতাল, কমরেড খোকন মজুমদার, কমরেড কদম মল্লিক ও আরও অনেক কৃষক নেতা।’ শীর্ণকায় অথচ বিপ্লবের আগুনে পোড় খাওয়া চারু মজুমদার বলেন যে, নকশালবাড়ির কৃষক নিছক জমির জন্যে লড়েন নি, লড়েছেন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য, লড়েছেন সংশোধনবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে। নকশালবাড়ির কৃষক ও সংগঠকদের সাথে সাথে এবার তিনি মনে গেঁথে যান বাংলার আপামর জনসাধারণের। তাঁর বিপ্লবী বিনম্রতাই মানুষের কাছে প্রমাণ করে দেয় যে তিনিই নকশালবাড়ির প্রকৃত নেতা, বাকিরা সংগঠক
প্রকাশ্য সভার দু দিন পর অর্থাৎ ১৩-ই নভেম্বর গঠিত হয় ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র বিপ্লবীদের সারা ভারত সমন্বয় কমিটি বা এআইসিসিআর অব সিপিআই-এম। পরে এর নাম বদলে রাখা হয় কম্যুনিস্ট বিপ্লবীদের সারা ভারত সমন্বয় কমিটি বা এআইসিসিসিআর। কো-অর্ডিনেশনের নেতৃত্বে আসেন চারু মজুমদার, কানু সান্যাল (মিটিং-এ অনুপস্থিত), সৌরেন বসু (মিটিং-এ অনুপস্থিত), খোকন মজুমদার, সুশীতল রায় চৌধুরী, সরোজ দত্ত, অসিত সেন, প্রমোদ সেনগুপ্ত, পরিমল দাশগুপ্ত, সত্যনারায়ণ সিং, গুরবক্স সিং, রাজকিশোর সিং, রামপেয়ারি শরাফ, শিবকুমার মিশ্র, শিউনন্দন তেওয়ারি, এল আপ্পু, চৌধুরী তেজেশ্বর রাও, নাগ ভূষণ পট্টনায়ক, ভেম্পাটাপ্পু সত্যনারায়ণ, আদিবাটলা কৈলাসম, পঞ্চান্দ্রী কৃষ্ণমূর্তি, কুন্নিকল নারায়ণ এবং আরও অনেক বিপ্লবী। অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেঙ্গানা আন্দোলনের নেতা তারিমেলা নাগী রেড্ডী, দেভুলাপল্লী ভেঙ্কটেশ্বর রাও ও চন্দ্রপুল্লা রেড্ডীও যোগ দেন এই দলে। তাঁরা বহু দিন ধরেই নিজেদের রাজ্যে সংশোধনবাদী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত লড়াই চালিয়ে আসছিলেন। দুঃখের বিষয়, বিবিধ কারণে তেলেঙ্গানার নেতাদের সাথে এই ঐক্য স্থায়ী হয় নি। পরবর্তীকালে এর জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে দু-পক্ষকেই।
নকশালবাড়ির আদলে কো-অর্ডিনেশনের নেতৃত্বে তৈরি হয় মহান শ্রীকাকুলামের কৃষক সংগ্রাম, ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশে। সৃষ্টি হয় মুশাহারি, লখিমপুর, খেড়ির কৃষক বিদ্রোহ। উড়িষ্যা থেকে পাঞ্জাব—সর্বত্র নকশালবাড়ির স্ফুলিঙ্গ দাবানল সৃষ্টি করে। সংশোধনবাদকে নাকচ করে কমিটির ছাতার নিচে একে একে এসে জমা হন ছাত্র-যুবরা। তাঁদেরই একটা অংশ মেদিনীপুর (অবিভক্ত), বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেনসারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে গোপিবল্লভপুর ও ডেবরার নাম। ২৪ পরগণার (অবিভক্ত) সুদূর সুন্দরবনেও কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে।
১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয় কানু সান্যালের লেখা ‘তরাইয়ের কৃষক আন্দোলনের রিপোর্ট’। এই রচনায় তিনি নকশালবাড়ির কৃষকের ১০-টি মহান কাজের বিশ্লেষণ করেন ও দু জায়গায় চারু মজুমদারকে ‘শ্রদ্ধেয় নেতা’ বিশেষণে ভূষিত করেন। কিন্তু খুব আশ্চর্যজনকভাবেই তিনি ‘ঐতিহাসিক আট দলিল’-এর প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রাম গড়ে তোলার পেছনে যাদের অবদান অনস্বীকার্য, সেই উত্তর বাংলা-বিহার সীমান্ত আঞ্চলিক কমিটির কমরেডদের এটা দৃষ্টি এড়ায় নি। তাঁরা ‘তরাই রিপোর্ট’-এর পালটা হিসাবে প্রকাশ করেন ‘নকশালবাড়ির শিক্ষা’ শীর্ষক দলিল, যাতে পরিষ্কারভাবে বলা হয় যে, আট দলিলের রাজনীতিই হল নকশালবাড়ির স্রষ্টা। কিন্তু এই দলিল সেভাবে প্রকাশ্যে না আসায় চিনা রেডিও ১৯৬৯ সালের ১০, ১১, ১৪ ও ১৭-ই মার্চ কানু সান্যালের ‘তরাই রিপোর্ট’-এর ব্যাপক প্রচার করে। ১৯৭১-এর আগে উক্ত দলিল সম্পর্কে সিপিআই (এম-এল)-এর নেতা বা সদস্য কেউই জানতেন না।
’৬৮-র ৩১-এ অক্টোবর, মধ্যরাত্রে বিরসিংজোতের কোনও এক কৃষকের মাটির ঘরে হানা দেয় পুলিশ। গ্রেফতার হয়ে যান ঘুমন্ত কানু সান্যাল ও কৃষক নেতা কেশব সরকার। জেলে গিয়ে তাঁরা অন্যান্য কমরেডদের সাথে মিলে অনশন শুরু করেন। ২৬-এ ডিসেম্বর কানু সান্যালকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। বাইরে তাঁর মুক্তির জন্য আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে, যার ফলে খুব বেশী দিন তাঁকে বন্দী করে রাখা যায় না ’৬৯-এর ৯-ই এপ্রিল জেল থেকে বেরিয়ে আসেন কানু সান্যাল। কোনও রকম সময় ব্যয় না করে তিনি কলকাতায় চলে আসেন ও চারু মজুমদারের সাথে দেখা করেন। ওই মাসের ১৯ থেকে ২২ তারিখ এআইসিসিসিআর-এর সর্বশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং শিউনন্দন তেওয়ারির আপত্তি সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত হয় নতুন পার্টি গঠনের। পার্টির কেন্দ্রীয় সংগঠনী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন কানু সান্যাল-সহ মোট ১১ জন, চারু মজুমদার হন সাধারণ সম্পাদক। ’৬৯-এর ১-লা মে এক বিরাট জনসভায় কানু সান্যাল ঘোষণা করেন সিপিআই (এম-এল) গঠনের কথা।
পার্টির নেতৃত্বে দিকে দিকে কৃষক আন্দোলনের বিকাশ ঘটে। চারু মজুমদারের ‘শ্রেণীশত্রু খতমের আন্দোলন’ দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের বিপ্লবী অবলম্বন হিসাবে উঠে আসে। বিপুল আন্দোলনের জোয়ারের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় পার্টির প্রথম মহাসম্মেলন, যা আসলে ছিল ভারতের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অষ্টম পার্টি কংগ্রেস। এখান থেকে কানু সান্যাল হন কেন্দ্রীয় কমিটি ও রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য। কংগ্রেস শেষ হলে তিনি ও সৌরেন বসু শ্রীকাকুলাম যাত্রা করেন সেখানকার কমরেডদের গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দিতে। কিছু মাস পর (আগস্টের মাঝামাঝি) বাংলায় ফিরে বৈরা বস্তির গোপন সভায় যোগ দিতে এসে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনিবুর্জোয়া সংবাদপত্রে রটানো হয় কানু সান্যাল স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন। এই প্রচারের বিরোধিতা করে শশাংক উত্তর দেন ‘দেশব্রতী’-র পাতায়।
দার্জিলিং জেলে থাকাকালীন বাইরে থেকে খবর আসে, বিহার রাজ্য কমিটি পার্টির কেন্দ্রীয় লাইন-সহ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে আক্রমণ করেছে এবং বিপ্লবী কর্তৃত্ব বিষয়ক প্রশ্নে বিরূপ মত প্রকাশ করেছেএই সমস্ত অভিযোগের বিরুদ্ধে জেল থেকেই কলম ধরেন কানু সান্যাল; দেখান কীভাবে চার পর্যায় ধরে ভারতের নির্দিষ্ট অবস্থার সাথে মিলিয়ে সৃজনশীলভাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও চিন্তাধারার বিকাশ ঘটিয়েছেন চারু মজুমদার, কীভাবে মুক্ত করেছেন ভারতের কম্যুনিস্ট আন্দোলনকে সংশোধনবাদী রাজনীতির হাত থেকেকিন্তু ১৯৬৫ থেকে চারু মজুমদারের সংশোধনবাদ বিরোধী সংগ্রামের কথা বললেও আট দলিলের কথা তিনি উল্লেখ করেন নি। জেল থেকে প্রেরিত এই লেখার শিরোনাম ছিল—‘কমরেড চারু মজুমদারের কর্তৃত্ব যারা ভাঙতে চায় তাঁদের থেকে হুঁশিয়ার’।
’৭০-এর শেষ থেকে একদিকে রাষ্ট্রশক্তির আক্রমণ ও অন্যদিকে উপদলীয় চক্রান্তের ফলে সিপিআই (এম-এল)-এর উপর বার বার আঘাত আসতে থাকে। এই উভয় সংকটের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে পার্টি লাইনের পক্ষে যে সমস্ত কমরেডরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও এক ধরনের অসহিষ্ণুতা তৈরি হয়। এমত পরিবেশে ঠিক হয় পার্টির কোনও একজন প্রতিনিধিকে চিনে পাঠানো হবে আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের সাথে পরামর্শ করতে। ১৯৭০-এর সালের শেষের দিকে সৌরেন বসু চিনের উদ্দেশ্যে রওনা হনকিন্ত সেখানেও তখন রীতিমতো ডামাডোলের পরিবেশ। সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ফ্রন্ট বানাতে গিয়ে তখন চিনা পার্টির ক্ষমতাসীন অংশ (চৌ এনলাই প্রমুখ) মার্কিনের সাথে বোঝাপড়ায় আগ্রহী। বিরোধী মতাবলম্বী লিন পিয়াও আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত (যদিও গোপনে), মাও সেতুং প্রায় অন্তরিন। সৌরেন বসুর সাথে আলোচনায় বসেন চৌ এনলাই এবং কাং শেং। যে সমস্ত কথাবার্তা চিনা নেতারা বলেন, তার ভুল-ত্রুটি বিচার না করেই সৌরেন বসু সব কিছু নিঃশর্তে মেনে নেন এবং ফিরে এসে চারু মজুমদারের কাছে রিপোর্ট দাখিল করেন। পার্টিতে বক্তব্য প্রচারের আগেই তিনি পুলিশের জালে আটকা পড়েন (মার্চ ১৯৭১) ও জেলের ভেতর এ নিয়ে আলাপ-আলোচনায় মেতে ওঠেন।
১৯৭১-এর ৫-ই আগস্ট পুলিশের হাতে নিহত হন সরোজ দত্ত। এক বছর পর (১৪-ই জুলাই, ১৯৭২) জনৈক পার্টি নেতার বিশ্বাসঘাতকতায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান চারু মজুমদার। ১৪ দিন পর অর্থাৎ ২৮-এ জুলাই পুলিশ কাস্টডীতে তাঁর মৃত্যু (আসলে হত্যা) হয়।
যে চারু মজুমদারের বিপ্লবী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কানু সান্যাল এবং সৌরেন বসু এক সময় আত্মনিয়োগ করেছিলেন, সেই চারু মজুমদারের মৃত্যু হওয়া মাত্রই তাঁরা অবস্থান বদল করেন—বলা যায় ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে যান। ৭২-এর শেষের দিকে বিশাখাপত্তনম জেল থেকে কানু সান্যাল, সৌরেন বসু-সহ ৬জন নেতা বুর্জোয়া গণমাধ্যমে সৌরেন বসুর সাথে চিনা প্রতিনিধিদের আলোচনার সারসংক্ষেপ (১১-দফা সাজেশন) প্রকাশ করেন এবং চারু মজুমদারের চরম সমালোচনা করেন। কিন্তু চিঠির মধ্যে কোথাও উল্লেখ করা হয় না যে চৌ এনলাইরা ভরসা রেখেছেন চারু মজুমদারের উপরেই এবং যে সমস্ত ‘ভুল’ হয়েছে বলে তাঁদের মনে হয়েছে তা শুধরে নেওয়া সম্পর্কে বলেছেন এই কথাগুলো—‘... শোধনকর্ম ধাপে ধাপে সম্পন্ন করাই সমীচীন, যাতে জনগণের ও পার্টি সদস্যদের বিপ্লবের প্রতি উৎসাহ কোনক্রমে আহত না হয়, শত্রুরা যাতে পার্টিকে জখম ও টুকরো করার মওকা না পায়। সুতরাং, ভুল শোধরাতে গিয়ে আমাদের মধ্যে যেন হঠকারিতা প্রকাশ না পায়। তড়িঘড়ি না করি। এ ব্যাপারে সতর্কতা চাই।’ চিঠি লেখার সময় এই সব নির্দেশ হয়ত সাময়িকভাবে বিস্মৃত হয়েছিলেন সৌরেন বসু, কানু সান্যালরা!
চিঠি প্রকাশের ক’মাস পর কানু সান্যাল ‘নকশালবাড়ি সম্পর্কে আরও কিছু কথা’ নাম দিয়ে এক দলিল লেখেন ও তা জেলের বাইরে প্রচারের ব্যবস্থা করেন। এই দলিলে তিনি চারু মজুমদারের বিধ্বংসী সমালোচনা করেন (যা প্রায় ব্যক্তি আক্রমণের পর্যায়েও পৌঁছে যায়) এবং দাবী করেন যে আট দলিলের বিরোধিতা করেই নাকি নকশালবাড়ি গড়ে উঠেছে। এর পেছনে পূর্ববর্তী গণআন্দোলনগুলোর অবদানই যে মুখ্য, এই কথাও বলেন। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—যদি শুধু আগের গণআন্দোলন ও শ্রেণী সংগ্রামের প্রভাবই কাজ করে থাকে, তাহলে অন্য কোথাও কেন দেখা দিল না বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ? কেন প্রথম দেখা দিল নকশালবাড়িতেই? এ কথা নিশ্চয় মনে করার কারণ নেই যে শ্রেণী সংগ্রাম একা নকশালবাড়িতেই ছিল। বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া তো কোনও বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে ওঠে না; নকশালবাড়ির পেছনে কোন তত্ত্ব, কোন রাজনীতি কাজ করেছিল? উত্তর বাংলা-বিহার সীমান্ত আঞ্চলিক কমিটির কমরেডদের মতে নকশালবাড়িতে যে কৃষক অভ্যুত্থান হয়েছিল তার পেছনে কাজ করেছিল এক নির্দিষ্ট রাজনীতি—আট দলিলের রাজনীতি। তাঁরা মনে করেন, এই রাজনীতির ভিত্তিতে ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে যে সমস্ত ছোট-বড় লড়াই হয়েছিল, তারই প্রত্যক্ষ ধারাবাহিকতায় তৈরি হয় নকশালবাড়ি। মাও বলতেন বাহ্যিক কারণ হল পরিবর্তনের শর্ত আর অভ্যন্তরীণ কারণ হল পরিবর্তনের ভিত্তি। সমস্যাটা তখই তৈরি হয় যখন এর আন্তঃসম্পর্ক গুলিয়ে যেতে থাকেকিন্তু কানু সান্যালের মতো একজন কম্যুনিস্টের ক্ষেত্রে কি তা কখনো সম্ভব?
বিশাখাপত্তনম জেলে থাকার সময় নাগী রেড্ডীর সাথে পরিচিত হন কানু সান্যাল। ১৯৭৫-এর এপ্রিল বিভিন্ন গোষ্ঠী মিলে তৈরি হয় ভারতের কম্যুনিস্ট বিপ্লবীদের ঐক্য কেন্দ্র (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) বা ইউসিসিআর (এম-এল)। কানু সান্যাল নাগী রেড্ডী মারফৎ খবর পাঠান যে তিনি জেলের ভেতরে নিজেকে ইউসিসিআর-এর প্রতিনিধি বলে মনে করেন।
১৯৭ সালে কানু সান্যাল ছাড়া পান। বেরিয়ে এসে তৈরি করেন কম্যুনিস্ট বিপ্লবীদের সংগঠনী কমিটি বা ওসিসিআর (এম-এল)১৯৮৫-তে তাঁর উদ্যোগেই ওসিসিআর (এম-এল), সুবোধ মিত্র পরিচালিত ইউসিসিআর (এম-এল), উমাধর সিংহ পরিচালিত সিওসি-সিপিআই (এম-এল), রবিশংকরের সিপিআই (এম-এল) কাইসুর রেঞ্জ, কৃষ্ণাপ্পার আইসিপি এবং সবুজ সেন পরিচালিত লিবারেশন ফ্রন্ট মিলে সৃষ্টি হয় ভারতের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কম্যুনিস্ট সংগঠন বা সিওআই (এম-এল)। কানু সান্যাল হন সাধারণ সম্পাদক। এর প্রায় দেড় দশক পর সিওআই (এম-এল), সিপিআইইউ (এম-এল) ও সিপিআই (এম-এল) ঐক্য উদ্যোগের মিলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে কানু সান্যাল আবার সিপিআই (এম-এল) নামে ফিরে আসেন। ২০০৫-এ রেড ফ্ল্যাগ গোষ্ঠীর সাথেও তাঁর অংশের ঐক্য হয়, যদিও তা বেশী দিন টেঁকে নি।
দুঃখের বিষয়, জেল থেকে বেরোবার পর থেকে বহু চেষ্টা স্বত্বেও কানু সান্যাল আর সেইভাবে ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনে কোনও স্বতন্ত্র ছাপ রাখতে পারেন নি। শেষের দিকে ভীষণভাবেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
অসুস্থ অবস্থায় রামচন্দ্রনের রেড ফ্ল্যাগ গোষ্ঠীর (এখন এরা ‘রেড স্টার’ গোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত) সাথে পার্টির ইতিহাস সংক্রান্ত বিতর্ককে কেন্দ্র করে ‘সিপিআই (এম-এল)-এর ইতিহাসের মূল্যায়ন’ নামে গুরুত্বপূর্ণ এক রচনা লিখেছিলেন তিনি, যা প্রকৃত অর্থে ১৯৭৩-এর দলিলের ধারাবাহিকতায় রচিত। এই রচনা প্রথমে পার্টির গোপন কাগজ ‘গাইড’-এ প্রকাশিত হয়, পরে ঐক্য ভেঙে গেলে তা প্রকাশ করা হয় তাঁর নিজের গোষ্ঠীর ইংরাজি মুখপত্র ‘ক্লাস স্ট্রাগল’-এলেখায় অন্যদের সাথে সাথে নিজের সমালোচনাও করেছেন তিনি। কিন্তু কিছু কথা ইতিহাসের নিরিখে মনে হয়েছে বড়ই স্ববিরোধী। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। এই প্রবন্ধের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন যে, চারু মজুমদারের খতম লাইন, যা না-কি তাঁর মতে নকশালবাড়িতে পরাজিত হয়েছিল, তা যখন সিপিআই (এমএল)-এর অন্যান্য রাজ্যের কমরেডরা সমর্থন করেন ও প্রয়োগ করতে থাকেন, তখন তিনি এর পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু না বলে ‘let’s wait and see’ ধরনের অবস্থান নিয়েছিলেন। জীবনের শেষের দিকের এই লেখা পড়ে মনে হয় কানু সান্যাল অনেক স্মৃতিই ভুলে গেছিলেন। দার্জিলিং জেল থেকে সত্যনারায়ণ সিং-এর দলিলের বিরোধিতা করে তিনি যে পালটা দলিল (পূর্বে উল্লেখিত) পাঠান, তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছিল তিনি খতম আন্দোলনকে সম্পূর্ণভাবে ঠিক মনে করেন এবং একে চারু মজুমদার কর্তৃক মাও চিন্তাধারার অস্ত্রভাণ্ডারে এক অমূল্য সংযোজন হিসাবে দেখেন ফলে ‘আমি মৌন ছিলাম’ বলে দায় এড়ানো কি আদৌ সম্ভব?
রেড ফ্ল্যাগ গোষ্ঠীর সাথে ঐক্য ভেঙে গেলে মুষড়ে পড়েন কানু সান্যাল। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া ব্যাহত হতে শুরু করে। খুব বেশী দিন বাঁচেনও নি তার পরমৃত্যু দড়ির এক ফাঁসে শেষ করে দেন অসুস্থতা ও বিপ্লবী সংগ্রাম না বেঁচে থাকার গ্লানি
তিনি চলে গেছেন, তবু মানুষ আজও অপেক্ষা করে আছে তাঁর কথা জানতে, তাঁর ভাবনার শরিক হতে। তাঁর লেখা পড়ে নি বেশিরভাগ মানুষ। কিন্তু তাঁরা পড়তে চান, জানতে নকশালবাড়ির কথা। উপরে আলোচিত চারটি রচনার মধ্যে তিনটি ‘এবং জলার্ক’-সহ অন্যান্য সংকলনে বা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু দার্জিলিং জেল থেকে লেখা চিঠিটি সীমাবদ্ধ থেকে গেছে পার্টির সদস্যদের মধ্যে। সিপিআই (এম-এল) ভেঙে যাওয়ার পরেও নানা অজানা কারণে এটি প্রচারেই আসে নি। ফলে, কানু সান্যালের মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট দূর করার লক্ষ্যেই চিঠিটি পত্রিকা কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হল।
কানু সান্যালের লেখাগুলি পড়ে বিভিন্ন মানুষ বিবিধ মতামত ব্যক্ত করেছেন, আগামী দিনেও করবেন। কিন্তু আশা করি কেউই অস্বীকার করবেন না লেখাগুলোর ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বকে। কানু সান্যাল কানু সান্যালই। যত যাই করুন তাঁকে অস্বীকার করা যাবে না। যত দিন শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, যত দিন নকশালবাড়ি ও চারু মজুমদারের নাম বেঁচে থাকবে, ততো দিন তিনিও থাকবেন, থেকে যাবে তাঁর নাম। —তিনি কালপুরুষ, তিনি কানু সান্যাল।

No comments:

Post a Comment