Man's dearest possession is life. It is given to him but once, and he must live it so as to feel no torturing regrets for wasted years, never know the burning shame of a mean and petty past; so live that, dying he might say: all my life, all my strength were given to the finest cause in all the world- the fight for the Liberation of Mankind. - Nikolai Ostrovsky

Monday, June 25, 2012

যুগ বিতর্ক—একটি বিশ্লেষণ - বাসু আচার্য (অপ্রকাশিত)



(১)
ভারতের কম্যুনিস্ট আন্দোলনে, বিশেষ ক’রে নকশালপন্থী আন্দোলনের ইতিহাসে, যুগের প্রশ্ন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান যুগ লেনিন-এর না মাও-এর,এই প্রশ্নকে কেন্দ্র ক’রে গত চার দশক ধরে সিপিআই (এম-এল) থেকে উদ্ভূত গোষ্ঠীগুলো অনবরত একে অপরের সাথে তিক্ত মতাদর্শগত সংগ্রামে লিপ্ত থেকেছে। এ হেন অবস্থায় আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো উপস্থিত হয়েছে ‘মাওবাদ’ নামক ব্যাধি, যা মাও চিন্তাধারার গুরুত্বকেই নাকচ ক’রে দিয়েছে। এই মুহূর্তে যখন বামপন্থী আন্দোলন সারা দেশে এক বিশাল ধাক্কার সম্মুখীন, তখন রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত স্তরে নিজেদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করতে আমাদের অবশ্যই যুগের প্রশ্নকে নির্মোহভাবে দেখতে হবে এবং তার ভিত্তিতে রণনীতি এবং রণকৌশল স্থির করতে হবে।
আমাদের ভুললে চলবে না যে, এই দুনিয়ায় কোনও কিছুই স্থির নয়, সব কিছুই চলমান, সব কিছুই গতিশীল, পরিবর্তনশীল। যান্ত্রিক বস্তুবাদের বিপরীতে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মূল কথাই হ’ল গতি, পরিবর্তন, বিকাশ এবং রূপান্তর। এই প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করা মানে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও চিন্তাধারার বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকেই অগ্রাহ্য করা। অতএব, সমস্ত ভুল ধারণাকে সরিয়ে ফেলে যুগের বৈশিষ্ট্যকে আমাদের এর আলোকেই বিচার করতে হবে। এই কাজ সঠিকভাবে করতে না পারলে আগামী দিনে আমরা আবার গোষ্ঠীবাদী প্রবণতার শিকার হবো, এবং একটা গুরুত্বহীন শক্তিতে অধঃপতিত হবো।
ছোট-বড় মিলিয়ে বর্তমানে আমাদের দেশে এম-এল পার্টি থেকে জন্মানো গোষ্ঠীর সংখ্যা ৫০-এরও অধিক। এদের মধ্যে বেশিভাগ গোষ্ঠীই মনে করেন, এটা হ’ল ‘সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগ’ অর্থাৎ এই যুগের পতাকা হলেন কমরেড লেনিন। উলটো দিকে এক দল এর বিরোধিতা ক’রে বলেন— এটা ‘সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের সামগ্রিক ধ্বংসের এবং সমাজতান্ত্রিক শক্তিগুলোর দুনিয়া-ব্যাপী বিজয়ের যুগ’, অর্থাৎ এযুগের নিশান হলেন কমরেড মাও সেতুং।
আমরা মনে করি, পুরো বিষয়টাকে এমন বিচ্ছিন্নভাবে দেখা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও চিন্তাধারার পরিপন্থী। লেনিন এবং মাও-এর মধ্যে দ্বন্দ্ব খোঁজার চেষ্টা কোনও কাজের কথা নয়। এটা এক ধরণের গোঁড়ামিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়। যারা এসব কথা বলেন তারা আদতে লেনিনবাদ বা মাও সেতুং চিন্তাধারা কোনোটাই মানেন না।
(২)
এখনও অবধি উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সর্বোচ্চ স্তর হ’ল লগ্নী পুঁজি। যদিও মনে রাখা দরকার যে, বর্তমানে লগ্নী পুঁজি শুধু মাত্র লেনিন ও বুখারিন-এর দেখানো সাবেক ধরণে আটকে নেই, ফিনান্স নিজেই একটা স্বাধীন স্বত্বা হয়ে উঠেছে। তা দেশ ও জাতির সীমানা ছাড়িয়ে উৎপাদন বহির্ভূত ফাটকা জগতে ব্যবহৃত হচ্ছে, এবং তার ফলে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের মাত্রা কিছু পরিমাণে প্রশমিত হয়েছে। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বার বার এটাই দেখাচ্ছে যে সাম্রাজ্যবাদীদের ভেতরকার দ্বন্দ্বের প্রশমন একটা ক্ষণস্থায়ী ব্যাপার। তাই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা যায়— এই যুগ হ’ল সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগ।
লেনিনবাদের ভিত্তিই হ’ল সাম্রাজ্যবাদ, যা পুঁজিবাদের প্রত্যক্ষ ধারাবাহিকতা হলেও প্রকৃত পক্ষে এর উচ্চতম স্তর, যেখানে পুঁজিবাদের ‘কতকগুলো মূলগত বৈশিষ্ট্য নিজ নিজ বিপরীত বস্তুতে রূপান্তরিত’ হয় এবং ‘পুঁজিতন্ত্র থেকে উন্নততর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উত্তরণের ক্রান্তিকালীন লক্ষণগুলো দিকে দিকে আকার গ্রহণ ও আত্মপ্রকাশ’ করে। তাই যতদিন এই ব্যবস্থা বর্তমান থাকবে, ততদিন লেনিনবাদও থাকবে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ সম্পর্কে তার বুনিয়াদি দিকগুলোও বহাল থাকবে (আজকের দিনে সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের বাইরেও বিভিন্ন ধরণের যে সমস্ত যুদ্ধ রয়েছে সেগুলো আসলে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থারই ফলশ্রুতি)।
সাম্রাজ্যবাদ ছাড়া পুঁজিবাদের আর কোনও উন্নত স্তর হয় না। অতএব এই মুহূর্তে যুগের ক্ষেত্রেও কোনও তৃতীয় গুণগত স্তর খুঁজতে যাওয়া বোকামি।
কিন্তু প্রশ্ন হ’ল, তাহলে মাও চিন্তাধারা কাকে বলব?
এটা সন্দেহাতীতভাবে সত্য যে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন ও স্তালিন-এর পরে বিশ্ব-সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রধান কাণ্ডারি হলেন মাও সেতুং। তিনি অবশ্যই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিজ্ঞানকে ঋদ্ধ করেছেন তাঁর দ্বন্দ্ব বিষয়ক তত্ত্বের বিস্তারিত ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে ও প্রোলেতারীয় ডিক্টেটরশিপ-এর অধীনে বিপ্লব বহাল রাখার প্রয়োজনীয়তাকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে, তত্ত্ব ও প্রয়োগের বাস্তব জমিতে স্থাপন ক’রে; তিনি অবশ্যই আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশে এবং নয়া-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে বিপ্লবী সংগ্রামের প্রধান রণনীতি হিসাবে দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছেন। কিন্তু কোনোভাবেই তাঁর এই সব ‘মৌলিক অবদান’ ‘স্বাধীন মতবাদ’ বা ‘ইজম’ হিসাবে গড়ে ওঠেনি, কেননা উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে কোনও নতুন গুনগত স্তর দেখা দেয়নি। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, কোনও কিছুই আকাশ থেকে পড়ে না; সব কিছুরই একটা বস্তুগত ভিত থাকে। সেই অনুযায়ী বিচার করলে দেখা যাবে, প্রতিটা মতবাদই হ’ল উৎপাদিকা শক্তির গুণগত বিকাশের ফসল। আমাদের দেশে এবং বাইরেও কিছু বিপ্লবী আছেন, যারা উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের ব্যাপারটা মাথায় না এনে ‘মৌলিক অবদান’-কে ‘স্বাধীন মতবাদ’-এর সাথে এক ক’রে ফেলেন এবং স্বাভাবিকভাবেই একাধিক ভুল চিন্তার বশবর্তী হয়ে পড়েন।
বিশ্বের বেশিভাগ দেশে সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত ক’রে শ্রমিকশ্রেণী ক্ষমতায় এলে, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটলে, তবেই আমরা বলতে পারব এযুগের নিশান লেনিনবাদ নয়, মাওবাদ। মাও-এর প্রধান অবদান: সর্বহারার শাসন কায়েম হওয়ার পরেও শ্রেণীসংগ্রাম বহাল থাকার কারণে বিপ্লবী লড়াই চালিয়ে যেতে হবে,—এটাকে তত্ত্ব ও প্রয়োগের মাটিতে সংগঠিতভাবে প্রতিষ্ঠা করা এবং অসামান্য বুদ্ধিমত্তার সাথে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। এটা একটা বিশ্বব্যবস্থায় কখনোই রূপান্তরিত হবে না যতক্ষণ না সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা ক্ষমতার অলিন্দ থেকে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। তাই বর্তমানে আমরা বলব: মাও চিন্তাধারা হ’ল শাখাস্তর বা উপযুগ—লেনিনবাদের বুনিয়াদী দিকগুলোর বিকাশমান রূপ, লেনিনবাদ থেকে আরও উন্নত কোনও মতবাদে আসার অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা। এই কারণেই নবম কংগ্রেস-এর রিপোর্ট পেশ করতে গিয়ে লিন পিয়াও বলেছেন, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অনিবার্যতা ও সমাজ বিপ্লবের পূর্বাহ্ণ হিসাবে তার আবির্ভাব—‘লেনিনের এইসব বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই সেকেলে হয়ে যায়নি।’ এই কারণেই চিনা পার্টি ‘মাওবাদ’ না বলে বলেছিল ‘মাও সেতুং চিন্তাধারা’।
যাইহোক, এতকিছুর পরেও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, লেনিনবাদের উৎপত্তির পর থেকে আজ অবধি বিশ্ব-পরিস্থিতির বিশাল বদল ঘটেছে। কিছু কিছু এমন পরিবর্তনের মুখোমুখি আমরা হয়েছি যা একধরণের গুণগত পরিবর্তনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। একে যদি এক ব্যাপক পরিবর্তন বলে অবিহিত করা হয়, তাহলে মোটেই বাড়াবাড়ি হবে না। এ নিয়ে বিষদ আলোচনার প্রয়োজন।
(৩)
যুগ সম্পর্কিত আলোচনার প্রথমেই যেটা উঠে আসে তা-হ’ল দ্বন্দ্বের বিশিষ্টতার জায়গা। মাও বলেছেন— ‘কোনও বস্তুর বিকাশের প্রক্রিয়ায় মূল দ্বন্দ্ব এবং এই দ্বন্দ্ব দ্বারা নির্ণীত প্রক্রিয়ার সারমর্ম প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বিলুপ্ত হয় না; কিন্তু বস্তুর বিকাশের একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় বিকাশের প্রত্যেক স্তরে অবস্থা সাধারণত পৃথক হয়। এর কারণ এই যে, একটা বস্তুর বিকাশের প্রক্রিয়ায় মূল দ্বন্দ্বের প্রকৃতি এবং প্রক্রিয়ার সারমর্ম অপরিবর্তিত থেকে গেলেও ঐ দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় এক স্তর থেকে আর এক স্তরে অতিক্রমণের সাথে সাথে মূল দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়। তাছাড়া, মূল দ্বন্দ্ব দ্বারা নির্ণীত বা প্রভাবিত বহু সংখ্যক প্রধান বা অপ্রধান দ্বন্দ্বের মধ্যে কতকগুলো তীব্রতর হয়, কতকগুলো সাময়িকভাবে অথবা আংশিকভাবে মীমাংসিত হয়, বা সেগুলোর তীব্রতা কমে যায়, এবং কতকগুলো নতুন দ্বন্দ্ব আত্মপ্রকাশ করে; এই কারণেই প্রক্রিয়া কতকগুলো স্তরের দ্বারা চিহ্নিত হয়।’
চিনা পার্টির নবম কংগ্রেস-এ লিন পিয়াও যখন তাঁর রিপোর্ট পেশ করেন, তখন লেনিনবাদের মৌলিক দ্বন্দ্বগুলোর (সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে নিপীড়িত জাতিসমূহের দ্বন্দ্ব, পুঁজিবাদী দেশের ভেতরে দুই যুযুধান শ্রেণীর—সর্বহারার ও বুর্জোয়ার—দ্বন্দ্ব, বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর নিজেদের ভেতরকার দ্বন্দ্ব, সাম্রাজ্যবাদী দেশের সাথে সমাজতান্ত্রিক দেশের দ্বন্দ্ব) নির্যাসে কোনও পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু দ্বন্দ্বগুলোর স্থান পরিবর্তন হওয়া, তাদের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়া এবং নতুন দ্বন্দ্বের আবির্ভাব ঘটার যে ঘটনা সেদিন আমরা দেখেছিলাম, তা অস্বীকার করা কোনও প্রকৃত মার্কসবাদী-লেনিনবাদীর পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সেদিন মূল দ্বন্দ্বে নিয়োজিত শ্রেণী দুটোর (সর্বহারা ও বুর্জোয়া) প্রকৃতি এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের ধনতান্ত্রিক সারাংশের কোনও পরিবর্তন হয়নি ঠিকই, কিন্তু তাদের দ্বন্দ্বের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার ভেতরেই একচেটিয়া পুঁজি এবং রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিক একচেটিয়া পুঁজির দ্বন্দ্বও আত্মপ্রকাশ করেছিলো।
তৃতীয়ত, লেনিন-এর আমলে সংশোধনবাদ আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়নি। কমরেড স্তালিন-এর মৃত্যুর পর খ্রুশ্চভ পরিচালিত বিংশ কংগ্রেস-এর মঞ্চ থেকে তা পাকাপাকিভাবে ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছিল। ফলে এই সময় সংশোধনবাদের সাথে জনগণের মৌলিক দ্বন্দ্বের আবির্ভাব ঘটেছিল। (অনেকে একে পুঁজিবাদী দেশের অভ্যন্তরে বুর্জোয়া ও সর্বহারাশ্রেণীর দ্বন্দ্বের সাথে এক ক’রে দেখেন। তারা ভুলে যান যে, যে-সমস্ত দেশে সংশোধনবাদীরা ক্ষমতায় আসে, সেখানে পুঁজিবাদ পুনর্প্রবর্তনের চেষ্টা চলে। কিন্তু পুনঃপ্রবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়া বা তার চেষ্টা চলার সাথে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রবর্তিত হওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ আছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পর্যায়ে মৌলিক পরিবর্তন সূচিত না হলে কোনোভাবেই দাবী করা যায় না যে, পুঁজিবাদী দেশের ভেতরে বুর্জোয়া ও সর্বহারার দ্বন্দ্বের সাথে সংশোধনবাদী দেশের ভেতরের পুঁজিবাদের পথগামীদের সাথে সেই দেশের সর্বহারাশ্রেণীর দ্বন্দ্বের চরিত্র এক রকম।)
উপরোক্ত বিষয়গুলো বাদে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটেছিল লেনিন-পরবর্তী দুনিয়ায়। এটা সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় মাও-এর এই উক্তির মধ্যে দিয়ে— ‘বিশ্বযুদ্ধের প্রশ্নে কেবলমাত্র দুটো সম্ভাবনা রয়েছে: হয় যুদ্ধ বিপ্লব ডেকে আনবে, না হলে বিপ্লব যুদ্ধ ঠেকাবে’। এই বক্তব্যের মধ্যেই রয়েছে সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারার বিপ্লবের যুগের বুনিয়াদি ও বিকাশমান দিক দুটো।
লেনিন-এর জীবিতাবস্থায় প্রধান দ্বন্দ্ব ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর নিজেদের ভেতরকার দ্বন্দ্ব, সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশগুলোতে পুঁজিপতি শ্রেণী ও শ্রমিকশ্রেণীর দ্বন্দ্ব এবং মুষ্টিমেয় উন্নত শোষক দেশগুলোর সাথে শত শত ঔপনিবেশিক ও পরাধীন দেশের জনগণের দ্বন্দ্বের সম্মিলিত জোট। রাশিয়া, যেখানে সমাজ বিকাশের সবকটা পর্যায় একই সাথে বিদ্যমান ছিল, হয়ে উঠেছিল এই দ্বন্দ্বগুলোর কেন্দ্রবিন্দু বা ফোকাল পয়েন্ট।
লেনিন লক্ষ করেছিলেন যে, সাম্রাজ্যবাদ সাধারণত পুঁজিবাদের সমস্ত দ্বন্দ্বকে বাড়িয়ে তুলে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায় ও অনিবার্যভাবে যুদ্ধে পর্যবসিত হয়, এবং এর ফলস্বরূপ খুলে যায় সমাজ বিপ্লবের দরজা, কেননা যুদ্ধের অবর্ণনীয় বিভীষিকা ও দুঃখকষ্টের জন্যেই জনগণ জেগে ওঠেন এবং তার ফলে সামাজিক বিকাশ ত্বরান্বিত করার প্রধান কারিগর হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন। ‘যুদ্ধ ইতিহাসের মধ্যে ভরবেগ সঞ্চার’ করে, এবং তা রেলগাড়ির মতো প্রবল গতিতে এগিয়ে চলে। লেনিন-এর বুনিয়াদী শিক্ষা অনুযায়ী যুদ্ধ বা ঐ ধরণের সুতীক্ষ্ণ সংকটের কারণে যখন সমাজের সমস্ত দ্বন্দ্ব এক বিস্ফোরণ বিন্দুতে এসে পৌঁছোয়, তখনই জন্ম হয় সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের দুর্বলতম গ্রন্থির। অতএব, লেনিনবাদী শিক্ষার মূল কথাটা হ’ল: ‘যুদ্ধ বিপ্লব ডেকে আনবে’।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে এক ধাক্কায় অনেক কিছু ওলটপালট হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক শক্তি ভারসাম্যেরও ব্যাপক বদল ঘটে। সোভিয়েত-এর হাতে ফ্যাসিবাদী দুর্গের ধ্বংসসাধন এবং চিনা কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে চিন বিপ্লবের সাফল্যের ফলে বিভিন্ন উপনিবেশ এবং আধা-উপনিবেশগুলোতে জনতার মুক্তি সংগ্রাম নতুন দিশা পায়। উপনিবেশগুলোকে কেন্দ্র ক’রে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। এর ফলে বিশ্বের মৌলিক দ্বন্দ্বগুলো দুনিয়ার গ্রামাঞ্চল অর্থাৎ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় কেন্দ্রীভূত হয় এবং সাম্রাজ্যবাদের সাথে (পরবর্তীকালে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথেও) নিপীড়িত জনতার দ্বন্দ্বই প্রধান দ্বন্দ্ব হয়ে ওঠে, এবং এই দ্বন্দ্বের সমাধানের ওপর বাকি দ্বন্দ্বগুলোর সমাধান নির্ভর করে। এই দেশগুলো মুক্ত না হলে পুঁজিবাদী দেশগুলোতে কিছু বিপ্লবী সম্ভাবনা তৈরি হলেও তা সমাজ বিপ্লবের পর্যায়ে যায় না, কেননা এই সব উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর শ্রমিককে সে-দেশের বুর্জোয়ারা পশ্চাৎপদ দেশ থেকে লুঠ ক’রে আনা অংশের একটা ভাগ ঘুষ হিসাবে দিয়ে সন্তুষ্ট রাখে। এইভাবে নিজেদের দেশের বিপ্লবী সংকটকে স্থগিত রাখার লক্ষ্যে সে নিজের সংকটের বোঝাটা ঔপনিবেশিক দেশের জনতার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। এর ফলে পৃথিবীর গ্রামাঞ্চলের জনতার সাথে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বন্দ্ব বিপ্লবী যুদ্ধের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল ক’রে তোলে। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সম্ভাবনা থাকলেও তা নির্ণায়ক নয়, কারণ বিপ্লবী যুদ্ধের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরোধিতাই হ’ল নতুন সম্ভাবনা।
চিনা পার্টির অষ্টম কেন্দ্রীয় কমিটির দশম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন থেকে দ্বন্দ্বের এই স্থানপরিবর্তন ও অন্যান্য দ্বন্দ্বের বহুমুখী বিকাশকে মান্যতা প্রদান করেন চেয়ারম্যান মাও সেতুং। খ্রুশ্চভ-এর দেউলিয়া, সংশোধনবাদী তত্ত্বের (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দুনিয়ায় সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সাথে সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের দ্বন্দ্বই প্রধান দ্বন্দ্ব) বিরোধিতা ক’রে তিনি বলেন, ‘সারা দুনিয়ার জনগণ এবং সাম্রাজ্যবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বই হ’ল প্রধান... সমস্ত দেশের জনগণ এবং সংশোধনবাদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব রয়েছে, দ্বন্দ্ব রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে, জাতীয়তাবাদী দেশগুলো ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অভ্যন্তরেও দ্বন্দ্ব রয়েছে, এবং রয়েছে সমাজতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব।’ মাও-এর এই বিশ্লেষণকে লিন পিয়াও সুসংহতভাবে উপস্থিত করেন তাঁর ‘জনযুদ্ধের জয় দীর্ঘজীবী হোক’ রচনায় এবং চিনা পার্টির নবম কংগ্রেসের রিপোর্ট-এ। মাও-এর দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের শিক্ষার আলোকে তিনি বলেন যে, গোটা পৃথিবীকে যদি একটা দেশ হিসাবে ধরা যায়, তাহলে ইউরোপ এবং আমেরিকা হ’ল শহরাঞ্চল, এবং এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো হ’ল গ্রামাঞ্চল; তাই আজকের আন্তর্জাতিক রণনীতি হ’ল এই সব মহাদেশের নিপীড়িত মানুষের নেতৃত্বে বিপ্লবকে সফল ক’রে বিশ্বের শহর ইউরোপ ও আমেরিকাকে ঘিরে ফেলা ও পরিশেষে দখল করা।
১৯৪৭ সালে মাও-এর লেখা ‘বর্তমান পরিস্থিতি ও আমাদের কর্তব্য’ শীর্ষক রচনায় তাঁর তুলে ধরা লাইনের নিরিখে ৬-এর দশকে চিনা পার্টির অষ্টম কেন্দ্রীয় কমিটির একাদশ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা করা হয়— ‘কমরেড মাও সেতুং আমাদের যুগের সবচেয়ে মহান মার্কসবাদী-লেনিনবাদী। কমরেড মাও সেতুং খুবই প্রতিভার সঙ্গে, সৃজনশীলভাবে ও সর্বাঙ্গীণভাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন, রক্ষা করেছেন এবং বিকশিত করেছেন ও মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে উন্নত ক’রে এক নতুন স্তরে নিয়ে গেছেন। মাও সেতুং চিন্তাধারা এমন এক যুগের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, যে যুগে সাম্রাজ্যবাদ সম্পূর্ণ ধ্বংসের পথে যাচ্ছে ও সমাজবাদ সম্পূর্ণ বিজয়ের পথে অগ্রসর হচ্ছে।’ ‘লাল বই’-এর ভূমিকায় (দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ) এবং পরবর্তীতে চিনা পার্টির নবম কংগ্রেসের দলিলে এই কথাগুলোই হুবহু লিখে দেন লিন পিয়াও। তাই যারা যুগ সংক্রান্ত প্রশ্নে সর্বত্র লিন পিয়াও-এর ভুত দেখেন, তারা হয় ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, নয়তো চরম ধুরন্ধর।
১৯৪৭ সালের মতোই, ১৯৬৮ সালের ১৬ই এপ্রিল আমেরিকার নিগ্রোদের লড়াইয়ের স্বপক্ষে বিবৃতি দিতে গিয়ে যুগের বিশেষ বৈশিষ্ট্যর কথা আবারও উঠে আসে মাও-এর কলমে। দু-ক্ষেত্রেই ‘নতুন যুগ’ কথাটা ছিল। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই ‘নতুন যুগ’ কথাটা ‘সাম্রাজ্যবাদের ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগ’-এর ব্যাপক বিকাশের নিরিখেই তিনি ব্যাবহার করেছিলেন। অক্টোবর বিপ্লবের পঞ্চাশতম বার্ষিকী স্মরণে লিন পিয়াও যে ভাষণ দেন, তা মনোযোগ সহকারে পাঠ করলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়। লিন বলেন— ‘গত পঞ্চাশ বছরে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পতাকাতলে অক্টোবর বিপ্লবের পথ অনুসরণ ক’রে বিশ্বের সর্বহারাশ্রেণী ও বিপ্লবী জনগণ বিশ্ব-ইতিহাসকে আর এক সম্পূর্ণ নতুন যুগে এগিয়ে নিয়ে এসেছেন, যে যুগে সাম্রাজ্যবাদ সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখে চলেছে এবং সমাজতন্ত্র এগিয়ে চলেছে বিশ্বব্যাপী বিজয়ের পথে। এটা হচ্ছে একটা মহান নতুন যুগ, যে যুগে সর্বহারাশ্রেণী এবং বুর্জোয়াশ্রেণী সারা বিশ্ব জুড়ে চূড়ান্ত লড়াইয়ে আবদ্ধ।’ স্বাভাবিক ভাবেই এখানে সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগের থেকে গুণগতভাবে স্বতন্ত্র কোনও যুগের প্রশ্নই নেই। কিন্তু ব্যাপক পরিবর্তনগুলোকে বোঝাতে গিয়ে লিন যেহেতু ‘সম্পূর্ণ নতুন’ শব্দ দুটো ব্যবহার করেছিলেন, সেহেতু একে কেন্দ্র করেই আমাদের দেশে ব্যাপক বিতর্ক দানা বেঁধেছিল।
মাও সেতুং এবং তাঁর সহযোদ্ধার বক্তব্যের মূল অর্থ না বুঝে যারা লেনিনবাদ এবং মাও চিন্তাধারাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখেন, তাদের থেকে সাবধান হওয়ার সময় এসেছে। যুগের বুনিয়াদী তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসাবে লেনিনবাদ যেমন সত্য, তেমনই তার বিকাশমান দিক হিসাবে মাও সেতুং চিন্তাধারাও সত্য। দুইয়ের মধ্যে কোনও বৈরিতা নেই। যা আছে তা হ’ল দুই সঠিকের দ্বন্দ্ব। বুনিয়াদী ভিত্তি ও তার বিকাশমান দিকের দ্বন্দ্ব। তাই নবম কংগ্রেস-এর মঞ্চ থেকে যে ঘোষণা করা হয়েছিল, ‘বর্তমান যুগের পতাকা হ’ল মাও সেতুং চিন্তাধারা’, তা আসলে লেনিনবাদকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে, প্রতিষ্ঠিত করেছে তার বিকাশমান দিককে।
(৪)
যুগ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা কেন চিনা পার্টির দশম কংগ্রেস-এর উল্লেখ করলাম না এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। চিনা পার্টির এই মোড় ঘোরানো মহাসম্মেলন সম্পর্কে আমরা চুপ থেকেছি এই যুক্তিতে নয় যে এখানে লিন পিয়াও-কে আক্রমণ করা হয়েছে। লিনকে ঘিরে একটা বিতর্ক আছে এবং সেই সংক্রান্ত যত সরকারী নথিপত্র, তাতেও প্রচুর অসঙ্গতি আছে। কিন্তু সেটা এই ক্ষেত্রে কোনও কারণ নয়, কেননা আমাদের ঝোঁক মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও চিন্তাধারার প্রতি, কোনও ব্যক্তি বিশেষের প্রতি নয়। মূল বিষয় হ’ল, দশম কংগ্রেস-এর রিপোর্ট-এ যুগ এবং অন্যান্য প্রশ্নে এমন কিছু অসঙ্গতি ও তাত্ত্বিক সুবিধাবাদ রয়েছে যা যেকোনো বিপ্লবী লড়াইকে বেপথু ক’রে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তবে অন্য সব বাদ দিয়ে এই মুহূর্তে আমরা শুধুমাত্র যুগের প্রশ্নের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোর ওপরেই মনোনিবেশ করবো।
দশম কংগ্রেসের রাজনৈতিক রিপোর্ট-এ চৌ এনলাই বলেছেন— ‘লেনিন-এর মৃত্যুর পর থেকে বিশ্ব-পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু যুগ পালটায়নি। লেনিনবাদের বুনিয়াদী নীতিগুলো অকার্যকরী হয়ে যায়নি; সেগুলো আজও আমাদের চিন্তার পথপ্রদর্শক এবং তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসাবে বিরাজ করছে।’ বলা বাহুল্য, এই বক্তব্য নিয়ে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু শুধু-মাত্র এইটুকু বললে যুগের ক্ষেত্রে একটা খণ্ডিত ধারণা তৈরি হয়। এর ব্যাপক বিকাশের দিকগুলো ধরা পড়ে না। এ নিয়ে আগেই বিষদে আলোচনা করা হয়েছে, তাই আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। যদিও দশম কংগ্রেস-এর রিপোর্ট-এর রাজনৈতিক অংশের (বাকি অংশগুলো-কে আর যাই বলা হোক রাজনৈতিক বলা যায় না; ‘পরিস্থিতি ও আমাদের কাজ প্রসঙ্গে’ শীর্ষক অংশটুকু ছাড়া বাকি সবটাই ব্যক্তি-কুৎসা) শুরুতে যুগের খণ্ডিত ধারণা উপস্থিত করার পেছনে ঠিক কী কারণ রয়েছে তা অনুসন্ধান করার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি।
আগের অংশে আমরা দেখেছি লেনিন-পরবর্তী সময়ে বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের সাথে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনগণের দ্বন্দ্বই প্রধান দ্বন্দ্ব। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের নিরিখে আমরা এও বলেছি যে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব মূল দ্বন্দ্বগুলোর অন্যতম হলেও আজ আর তা দুনিয়ার প্রধান দ্বন্দ্ব নয়। কিন্তু এটাকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে চৌ এনলাই রীতিমতো চাতুর্যের সাথে নানা রকম বিপ্লবী বাগাড়ম্বরের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বটাই প্রধান দ্বন্দ্ব এবং এদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ইউরোপ; তাই সারা পৃথিবীর জনগণের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ইউরোপ-কে কেন্দ্র ক’রে দুই অতিবৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যকার শক্তি পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নানান মারপ্যাঁচে এই কথা বলে চৌ এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা করেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য: প্রথমত, জনগণ নিজেই তাঁর ভাগ্যের নিয়ন্তা,—এই আত্মবিশ্বাসে চিড় ধড়িয়ে দেওয়া; এবং দ্বিতীয়ত, তাত্ত্বিক জালিয়ারতি ধুম্রজাল বিস্তার ক’রে ও বিশ্বযুদ্ধের জুজু দেখিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনগণের মনোবল ভেঙে দিয়ে বহু রক্তের বিনিময়ে তৈরি হওয়া জনযুদ্ধকে বানচাল করা। প্রধান দ্বন্দ্বের প্রশ্নটাকে সংশোধনবাদী চৌ গুলিয়ে দিতে চেয়েছেন মূলত দুনিয়ার সবচেয়ে ঘৃণ্য শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালালি করার উদ্দেশ্যে।
দশম কংগ্রেস-এর রিপোর্ট-টা একটু মন দিয়ে পড়লে বেশ বোঝা যায় যে সেখানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে উপস্থিত করা হয়েছে একটা পড়ন্ত শক্তি হিসাবে এবং উলটো দিকে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে দেখানো হয়েছে এক আগ্রাসী অতিবৃহৎ শক্তি রূপে। এই বিষয়টা আরও ভালোভাবে পরিষ্কার হয়েছে চিনা পার্টির একাদশ এবং দ্বাদশ কংগ্রেস-এ।
৭-এর দশকে যখন চৌ সোভিয়েত আগ্রাসনের ভয় দেখাচ্ছেন তখন দুনিয়া জুড়ে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার মতো বৈষয়িক অবস্থাই তার ছিল না। তা সত্ত্বেও এই বাস্তব সত্যকে চৌ অস্বীকার করেছিলেন আমেরিকার লেজুড়বৃত্তি করার জন্যে। তার জন্য বেশ কৌশলে যুক্তি সাজাতেও তিনি দ্বিধা করেননি। দশম কংগ্রেস-এর রিপোর্ট-এর এক জায়গায় তিনি চিন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশের কথা বলে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী চরিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন (যদিও চেপে গেছেন যে প্রথম সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আমলে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা চেনপাও দ্বীপ আক্রমণ করলে চিনা লাল বাহিনী তাদের ঝেড়ে কাপড় পড়িয়ে দেয়, এবং এই আক্রমণ সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিচার ক’রে চেয়ারম্যান মাও সঠিকভাবেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে জনতার প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেন)। এর কিছু পরেই এক জায়গায় হঠাৎ বিভিন্ন ‘আপোষ’-এর গুণাগুণ বিচার করেছেন। কিছু কিছু সময়ে যে বিপ্লবী দেশ ও সাম্রাজ্যবাদী দেশের মধ্যেও আপোষ প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে, এটা বেশ জোরের তুলে ধরেছেন। এই লাইন প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তিনি লেনিন উদ্ধৃত করেছেন, ব্রেস্ট লিটভস্ক চুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন।
বলা বাহুল্য, এখানেও সেই ‘এক ঢিলে দুই পাখি’ মারার খেলা— (১) একদিকে সীমান্তে সৈন্য মোতায়েনের মূল পাণ্ডা সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার ‘প্রধান আগ্রাসী’ শক্তি সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করার জন্য ‘পড়ন্ত’ সাম্রাজ্যবাদী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, এবং দুই শক্তির প্রতিযোগিতার কারণে অসন্তোষে ভোগা জাপান ও পশ্চিম ইউরোপ-এর দেশগুলোর সাথে সোভিয়েত বিরোধী ‘আপোষ’ করলে ক্ষতি নেই,—এই ঘৃণ্য রাজনীতি প্রচার করা (পরবর্তীকালে এই মতামতই তাত্ত্বিকভাবে আরও বিস্তৃত আকারে উপস্থিত হয় ‘তিন বিশ্বের তত্ত্ব’ নাম নিয়ে); (২) অন্যদিকে পূর্বাপর সম্বন্ধ গুলিয়ে দিয়ে ‘ব্রেস্ট’ চুক্তির গুণকীর্তন ক’রে সাম্রাজ্যবাদের হাতে কোনও স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব আক্রান্ত হলে তার সাথে আপোষ ক’রে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ নীতি গ্রহণ করাই ঠিক,—এই আত্মসমর্পণবাদী লাইন গেলানো।
সোজা কথা হ’ল, পচে যাওয়া মুমূর্ষু সাম্রাজ্যবাদ-কে হার না মানা দানব হিসাবে সামনে এনে, বিশ্বযুদ্ধের ভয় দেখিয়ে জনতার উদ্যোগের দ্বার বন্ধ ক’রে দেওয়ার চেষ্টাই করা হয়েছে দশম কংগ্রেস-এর দলিলে। তবে এইসব বদমায়েশি খোলাখুলি করার হিম্মৎ চৌ এনলাই-এর ছিল না। তাই তিনি মাও-এর নাম নিয়েই মাও-বিরোধিতার ঘুটি সাজিয়েছিলেন। বিপ্লবী উদ্ধৃতির আড়ালে গড়ে তুলেছিলেন সংশোধনবাদী ইমারত। দশম কংগ্রেস-এ যেখানে চৌ এনলাই ঘোমটার নিচে খ্যামটা নেচে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে ফ্রন্ট গড়ার ওকালতি করেছে, সেখানে নবম কংগ্রেস-এ লিন পিয়াও তুলে ধরেছেন বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিক ফ্রন্ট গঠনের সঠিক চাবি-কাঠি: ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং সোভিয়েত সংশোধনবাদের আগ্রাসন, নিয়ন্ত্রণ, হস্তক্ষেপ ও পীড়নের শিকার সমস্ত দেশ ও জনগণ, আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, সম্ভাব্য সর্ববৃহৎ যুক্তফ্রন্ট গঠন করি এবং আমাদের সাধারণ শত্রুকে ছুঁড়ে ফেলি।’
চিনা পার্টির দশম কংগ্রেস-এর দলিল হ’ল মধ্যপন্থী রাজনীতির এক অসামান্য উদাহরণ। এই দলিল পড়তে গিয়ে আমাদের ভুললে চলবে না কমরেড চারু মজুমদারের সতর্ক বানি— ‘...আমাদের সতর্ক থাকতে হবে মধ্যপন্থার বিরুদ্ধে। মধ্যপন্থা এক ধরণের সংশোধনবাদ, মধ্যপন্থা সংশোধনবাদের জঘন্যতম রূপ। অতীতে সংশোধনবাদ বিপ্লবীদের হাতে বারবার পরাজিত হয়েছে এবং প্রতিবারই মধ্যপন্থা এই লড়াইয়ে জয়ের ফলকে কব্জা করেছে এবং পার্টিকে সংশোধনবাদের পথে নিয়ে গিয়েছে। আমাদের ঘৃণা করতে হবে মধ্যপন্থাকে।’
প্রথম সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফলকেও ঠিক একইভাবে কব্জা ক’রে নিয়েছিল চিনা কম্যুনিস্ট পার্টির মধ্যপন্থী নেতৃত্ব। দশম কংগ্রেস-এর রিপোর্ট তার প্রথম সংগঠিত প্রকাশ। এই রিপোর্ট-এর হাত ধরেই পরবর্তীকালে চিনা নেতৃত্ব সংশোধনবাদী পাঁকে গা ডুবিয়ে ক্রমে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী অবতারে আত্মপ্রকাশ করে।
(৫)
গত শতকের ৮-এর দশকের শেষ থেকে পৃথিবীর দেশে দেশে সর্বহারার শ্রেণী আন্দোলন যেভাবে একের পর এক ধাক্কার মুখে পড়েছে, তাতে বাম ও কম্যুনিস্ট মহলে বিরাট বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, আন্দোলনের জগতে তৈরি হয়েছে বিশাল শূন্যতা। এমতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই অনেকে প্রশ্ন করছেন ‘এই যুগে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ মরণের পথে এগিয়ে চলেছে এবং বিশ্ব-সমাজতন্ত্র ও জনগণতন্ত্র এগিয়ে চলেছে বিজয়ের পথে’এই বক্তব্য কতোটা ঠিক?
আমরা মনে করি এই বক্তব্যে কোনও ভুল নেই। ১৯৪৭ সালে মাও যখন এই কথাগুলো উচ্চারণ করেন তখনকার বস্তুগত ও বিষয়ীগত অবস্থা ঠিক কি ছিল সেটা আগে দেখা দরকার। সমগ্র বিষয়ের দ্বান্দ্বিক মূল্যায়ন করলে আমরা বুঝতে পারব ‘এই যুগে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ মরণের পথে এগিয়ে চলেছে’ অংশ পুঁজিবাদের বিষয়গত অবস্থা বা ‘অবজেক্টিভ সিচুয়েশন’-এর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে, এবং পরের অংশটা তুলে ধরেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিপ্লবী শক্তির বিষয়ীগত বা ‘সাবজেক্টিভ’ দিক-কে।
আজকের দিনে কম্যুনিস্ট পার্টিগুলো বিষয়ীগত প্রস্তুতির দিক থেকে পিছিয়ে পড়লেও বস্তুগত দিক থেকে বিচার করলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ তার শেষ সীমায় এসে দাঁড়িয়েছে। সম্পূর্ণ পচাগলা অবস্থায় সে কবরে এক পা ঢুকিয়েও মরণ কামড় দিতে চাইছে। বিশ্ব-অর্থনৈতিক মন্দার বাড়বাড়ন্ত এটাই প্রমাণ করে যে পুঁজিবাদ আজ ভেন্টিলেশন-এর রোগী বই কিছু না। ফলে এই যুগ-কে ‘পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মরণের যুগ’ বললে মোটেও ভুল বলা হয় না। কিন্তু চিনা পার্টির দশম কংগ্রেস-এ যেমন বলা হয়েছে—‘যে যাই করুক না কেন, ফুল ঝরে যাবেই’—ব্যাপারটা মোটেই তেমনভাবে ঘটে না। পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ নিজে নিজে ধ্বংস হয় না। একমাত্র আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণী তাঁর অগ্রবাহিনীর নেতৃত্বে জোরদার আঘাত হেনেই এই কাজ করতে পারে।
(৬)
বিশ্ব-পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ ক্রমশ এগিয়ে চলেছে মৃত্যুর দিকে। তাই আজ আমাদের কাজ হ’ল নিজেদের শক্তিকে সংগঠিত ক’রে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার ওপর চরম আঘাত হানা। জয় আমাদের হবেই, কারণ আমাদের অস্ত্রভাণ্ডারে আছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও চিন্তাধারার মতো অমোঘ হাতিয়ার! পথে নানা বাঁক থাকবে, থাকবে নানান সমস্যা, কিন্তু এতে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

ইনকিলাব জিন্দাবাদ!

No comments:

Post a Comment