.........
—টিকিট? না, নেই। ২৪ তারিখ একটা শো আছে অ্যাকাডেমিতে, সেদিন ট্রাই করুন।
—আজকেরটাই শেষ শো না?
—হ্যাঁ, আমাদের এটাই
শেষ শো। ওটা ‘কল...’।
—আই সি! এটা তাহলে মিসড্ কল!
ফোন
কেটে গেল। আমার অসভ্যচিত শ্লেষের কারণে হয়তো ওপারের কণ্ঠের মালিক চলভাষের ‘লাল’ বোতাম টিপে
দিলেন। অগত্যা উপায়ন্তর নেই দেখে চন্দনদাকে (সেন) ফোন করতে হ’ল। মিনিট ১০-এর মধ্যেই টিকিট হাজীর।
প্রায়
এক দশক পর আবার ‘গালিলেও’-এর
মুখোমুখি। ভেতরে ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা বোধ করছি। সেবার বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকের
ভূমিকায় ছিলেন কুমার রায়, এবার অঞ্জন
দত্ত। সময়ের সাথে সাথে আরও অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। বহুরূপীর প্রযোজনা
দেখেছিলাম ৪০ টাকায়, সেখানে অঞ্জন দত্ত’র দর প্রায় ৮গুণ—৩০০; দর্শকদের ক্যারেক্টার-ও বেশ অন্যরকম। প্রথমটার ক্ষেত্রে
মোটামুটি মিলিয়ে মিশিয়ে সব রকমের মানুষ ছিলেন। অঞ্জনের অধিকাংশ দর্শকই ‘বাফার’ শ্রেণীর
অন্তর্গত, আমার মতো ফতুয়া-পাজামা ক্ল্যাড একজনও
নেই।
যাইহোক, চা-বিড়ি পর্ব শেষ ক’রে
ঢুকে পড়লাম জ্ঞানমঞ্চে, সিট নং ‘কিউ’-৬।
হলে
ঢোকার মুহূর্তে ছাপার অক্ষরে দেওয়া নির্দেশকের কৈফিয়তটা পড়ে ওঠার আগেই, আধ সেকেন্ডের বিরতিতে, দ্বিতীয়
এবং তৃতীয় বেল বেজে উঠল। কিছু লোক মঞ্চের ওপর উঠে কাওতালি শুরু ক’রে দিল—‘আরে একি!
রেডি হওয়ার আগেই বেল দিল কে!’ ইত্যাদি। নাটক
শুরু হয়ে গেছে। সামনের সিটে বসা তরুণী বলে উঠলেন—‘উফ!
কপিবুক ব্রেশট!’ চমকে উঠলাম! ‘অরগানন’-এর কোন্
পাতায় এমন সূচনার কথা লেখা আছে মনে করতে পারলাম না।
এমনিতে
অঞ্জন দত্তকে আমি বড় ভয় করি। তিনি যতটা না ওয়েস্টার্নাইজড্ তার চেয়ে ঢের বেশী
অ্যাংলিসাইজড্। ‘সেন্ট’ উপাধিওলা
ইস্কুলের সবকটা [বদ]গুণই গিজগিজ করছে ওঁর মধ্যে। কে জানে, হয়তো গালিলেওকেই গিটার
হাতে স্টেজে তুলে দেবেন! হয়তো গেয়ে উঠবেন ‘পাড়ুয়া শহরের রেলিংটায়...’। তাই ভয়
ছিলই। কিন্তু না। তেমন ভয়াবহ কিছু হ’ল না। হালকা
আলো জ্বলে উঠল। মূল মঞ্চের পেছনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নীল দত্ত অ্যান্ড টিম।
গিটার এবং পারকাশান-সহযোগে শুরুর কাপলেটের সাংগীতিক উপস্থাপন করলেন তারা, ব্রেশটীয়
কম্পোজিশন মেনেই, যদিও, একেবারে
নিজস্ব ঢঙে। আস্তে আস্তে মূল মঞ্চে আলো ফুটে উঠল, দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া স্তূপীকৃত
[খবরের] কাগজ বোঝাই ঘরে দেখা গেল গালিলেও-কে। গা ধুচ্ছেন, ছোট
আন্দ্রেয়ার সাথে কথা বলতে বলতে। কখনো কখনো ট্রাউজার্সের ওপর দিয়েই অণ্ডকোষে একটানা
চুলকে যাচ্ছেন, সামনে ছেড়ে কখনো হাত চলে যাচ্ছে পিছনে, দাবনায়। আবারও সেই তনয়ার
[দুষ্টু] কণ্ঠস্বর ভেসে এলো সামনের সিট থেকে—‘মাই
গড! হি’জ্ স্ক্র্যাচিং হিজ্ বলস্!’... (সাধারণত, হাত
দুটো নিয়ে ঠিক কী করবেন অঞ্জন তা মাঝেই মাঝেই বুঝে উঠতে পারেন না। এক্ষেত্রে একটা
হাতকে অন্তত খানিকক্ষণ তিনি ব্যস্ত রাখতে পেরেছেন। এছাড়া, ব্যপারটা খুব একটা
অস্বাভাবিকও নয়। কেজো সায়েবরা সেভাবে স্নান-টান করেন না, গায়ে
আতর ঢেলেই কাটিয়ে দেন দিনের পর দিন। সময় কোথায়? ঊর্ধ্বাঙ্গে
একটু আধটু জল ছিটলেও, নিচের দিকে আর নামা হয় না। তার ওপর
আবার সপ্তদশ শতাব্দীর ভেনিস। চামড়ার পোশাক। চুলকুনি না হয়ে যায়!)
ব্রেশটের
‘গালিলেও’-এর একাধিক সংস্করণ আছে। ১৯৩৮ সালে যখন প্রথম লেখেন, ব্রেশট এর নাম দেন ‘পৃথিবী
ঘোরে’। ক’মাসের মধ্যেই অবশ্য নাম বদলে গেল, নতুন নাম ‘গালিলেওর জীবন’। এভাবে বার
বার বদলে গেছে ‘গালিলেও’, কখনো নাটকের গঠন পালটেছে, কখনো বা পালটে গেছে গালিলেওর
চারিত্রিক দিকগুলো। ১৯৪৭ সালে হলিউডে চার্লস ল’টনের সাহায্যে যে ‘গালিলেও’ মঞ্চস্ত
হয়েছিল, তাতেও নানান পরিবর্তন এনেছিলেন ব্রেশট। তবে এখানেই শেষ নয়, আরও দুবার
‘গালিকেও’-কে নিয়ে কাটাছেঁড়া করেন তিনি, একবার ১৯৫৩-এ, আর একবার ’৫৫ সালে।
বাংলাতেও
নানা মানুষ নানা সময় এই নাটক অনুবাদ করেছেন, প্রযোজনা করেছেন। ১৯৬৫ সালে ঋত্বিক
ঘটক প্রথম এর অনুবাদ প্রকাশ করেন। তার পরিমার্জিত সংস্করণ অভিনয় করেন বর্ধমান
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ। অবন্তীকুমার সান্যাল নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। পরে,
১৯৮০ সালে, কুমার রায় কৃত অনুবাদকে আশ্রয় ক’রে, তাঁরই নির্দেশনায়, বহুরূপী
‘গালিলেও’ মঞ্চস্তু করে। প্রথমে অমর গাঙ্গুলি, পরে কুমার রায় নিজেই গালিলেওর
চরিত্রে অভিনয় করেন। প্রায় একই সময়ে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ অবলম্বনে, জর্মন
(পূর্ব) মঞ্চপরিচালক ফ্রিৎস্ বেনভিৎস্-এর পরিচালনায়, আধ-ডজন গোষ্ঠী মিলে প্রযোজনা
করে ‘গালিলেওর জীবন’। গালিলেওর ভূমিকায় অভিনয় করেন শম্ভু মিত্র। এছাড়াও, এই নাটকের
একটা একাংক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন জনৈক প্রবীর দাশগুপ্ত। বিভিন্ন কম্পিটিশনে তিনি
অভিনয় করতেন। বালুরঘাটের কোনও এক নাট্যগোষ্ঠীও এটা মঞ্চস্থ করেছিল ৮-এর দশকে।
প্রযোজনার
জন্য অঞ্জন দত্ত ল’টনের ভার্শানটাই বেঁছে নিয়েছেন। ১৯৭৫ সালে এর থেকে একটা ইংরাজি
ছবি হয়েছিল। নিজের প্রযোজনাকে সাজাতে তিনি হয়তো তার থেকে কিছু অনুপ্রেরণাও
নিয়েছেন। কিন্তু সেসব নেহাতই গৌণ ব্যাপার। অঞ্জনের ‘গালিলেও’ বাংলা রঙ্গমঞ্চে একটা
আলাদা ছাপ রাখতে পেরেছে, সন্দেহ নেই। হতাশ করেন নি আমাদের। তাঁর ছবি বা গানগুলো
যেমন, তাঁর নাট্য প্রযোজনা মোটেই তেমন নয়— ব’সে দেখা যায়, উপভোগ করা যায়।
‘এলিয়েনেশন
এফেক্ট’-এর প্রয়োগেও অঞ্জন দত্ত যথেষ্ট নান্দনিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এমনিতে আমাদের
এখানে এলিয়েনেশনের নামে যা চলে, তার থেকে ঢের ভালোভাবে তিনি উৎরে গেছেন।
এখানে
একটা ব্যপার পরিষ্কার করা দরকার। এলিয়েনেশন ব্যপারটা আমি ঠিক বুঝি না। মার্কসের
এলিয়েনেশন এক রকম (১৮৪৪-র দার্শনিক ও অর্থনৈতিক পাণ্ডুলিপি), ব্রেশটের এলিয়েনেশন
আর এক রকম। দুটোই কমপ্লিকেটেড, দুটোই এই বঙ্গসন্তানের মাথা আউলে দেওয়ার পক্ষে
যথেষ্ট। তার ওপর ব্রেশট সম্পর্কে আমার ভরসা একেবারেই হাত-ফেরতা জ্ঞান। প্রথমত, আমি
জর্মন জানি না, তাঁর অধিকাংশ নাটক ও ‘অরগানন’ ইংরাজিতে পড়েছি; দ্বিতীয়ত, ব্রেশটের
কোনও প্রযোজনা আমি দেখি নি, মায় হেলেন ভাইগেলের ‘মুটার কুরাজ’-এর ফিল্ম ফুটেজও না;
তৃতীয়ত, তাঁর থিয়েটার সম্পর্কে আমার ধারণা গড়ে উঠেছে ভারতের এবং বাইরের দু-চারজন
বামপন্থী লেখক মারফৎ। তিন নং পয়েন্টটা সবচেয়ে ভয়াবহ, কেননা এঁদের সবার মধ্যেই
আন্দ্রেই ঝানভের আত্মা থেকে গেছে। তত্ত্বে এবং তর্কে এঁদের জুরি মেলা ভার। এঁরা এমন
কূট তাত্ত্বিক যে আপনাকে কথার মারপ্যাঁচে কাত ক’রে দেবেন। যখন সংবিৎ ফিরবে, তখন
দেখবেন ‘দ্যা থ্রোন ইজ দেয়ার, বাট ইউ হ্যাভ বিন ওভারথ্রোন’ মার্কা অবস্থায় পড়ে
আছেন।
সে
যাকগে যাক, যা বলছিলাম, এলিয়েনেশন বলতে আমি একটাই জিনিষ বুঝি, দর্শক চরিত্রে হারিয়ে যাবে না, নাটকের ভালো খারাপ সে কনশাসলী
এঁচে নেবে, এবং এটা যাতে সম্ভব হয়, তার জন্য
নাট্যাভিনয়ের সময় কিছু বিশেষ টেকনিক ব্যবহার করতে হবে। অঞ্জন এটা যথাযথভাবে পালন
করেছেন, চলভাষের সুর বাজিয়ে, অন্যদের সাথে সেট অ্যান্ড প্রপস্ সাজিয়ে বা স্টেজ
ঝাঁট দিয়ে...।
bakita de!
ReplyDelete