মনোজগতে
শ্রমিকশ্রেণীর ক্ষমতা কায়েমের লড়াইকে শান্তিপূর্ণ দিশা দিতে চাইলেও, সাধারণভাবে, সমগ্র
বিশ্বেই ফলিত কম্যুনিস্ট ধারার অনুগামীরা মনে করেন— ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে
সন্ত্রাস একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বা করবে। শ্রমিকরাষ্ট্র গড়ে তোলা ও
তাকে রক্ষা করতে অস্ত্রের কর্তৃত্বমূলক প্রাধান্য যে অবশ্যম্ভাবী, তা এঙ্গেলস
দ্যার্থহীন ভাষায় উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালে লেনিন বা মাও-ও, শ্রেণীসংগ্রামের
নানান পথের কথা উল্লেখ করা সত্ত্বেও, চূড়ান্ত পর্বে অস্ত্র তুলে নেওয়াকেই সমীচীন বোধ
করেছেন। এমনকি, পূরণচাঁদ জোশির মতন তথাকথিত নরম-শরম নেতাও একবার বলেছিলেন—বিপ্লবের
শৈশবকাল হ’ল সন্ত্রাস। সিপিআই বা সিপিআই (এম)-এর মতন দলগুলোও তাদের ঘোষণাপত্রে ও
কর্মসূচিতে সোজাসুজি সশস্ত্র সংগ্রামের
কথা না বললেও একটা হালকা আভাষ দিয়ে রেখেছে। রাষ্ট্র যখন তার দশপ্রহরণ নিয়ে শ্রেণীশত্রুর স্বার্থে শ্বেতসন্ত্রাসে
অবতীর্ণ, তখন মেহনতি মানুষের প্রতিরোধ আন্দোলন তো লালসন্ত্রাসের রূপ পরিগ্রহ
করবেই।
তবে, এটা ভুলে গেলে চলবে না যে সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসবাদ এক
জিনিষ নয়। সন্ত্রাস যেখানে একটা রণকৌশলগত পদ্ধতি, সেখানে সন্ত্রাসবাদ হ’ল একটা
রণনৈতিক মতবাদ। এতে শ্রেণী আদর্শের বালাই নেই, নির্বিচারে হত্যা ও ব্যক্তিগত
বীরত্বের হঠকারিতাই সম্বল। সন্ত্রাসবাদ আদতে শাসকশ্রেণীর হাতকেই মজবুত করে, ব্যক্তিহত্যা
মারফৎ সংগ্রামের সমস্ত সম্ভাবনাকে নষ্ট করে। তাই একদিকে কম্যুনিস্টদের যেমন নিষ্ক্রিয়
‘বুড়োমি’র বিরুদ্ধে লড়তে হয়, অন্যদিকে তেমনই কঠোর হতে হয় বিপ্লবী হঠকারিতায় মোড়া
‘খোকামি’ রোগ সম্পর্কে।
আজ
অবধি যত দেশে বিপ্লব হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই সন্ত্রাসমূলক রণকৌশল অবলম্বন করতে
হয়েছে। মার্কস যদিও কিছু দেশে শান্তিপূর্ণ
উপায়ে ক্ষমতা বদলের সম্ভাবনা দেখেছিলেন, সেগুলো নানান কারণে সম্ভব হয় নি। পুঁজির
একচেটিয়াকরণ ও তার ফলে সাম্রাজ্যবাদের অভ্যুদয় শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ার উপর এক
ধরনের কুঠারাঘাতই করেছে। স্তালিনোত্তর যুগে আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলনে খ্রুশ্চভ
ও তাঁর মতবাদের বিপুল প্রভাব থাকা সত্ত্বেও এই পথ খুব একটা সাফল্যলাভে সক্ষম হয়
নি। ’৭-এর দশকের শুরুতে চিলির আয়ান্দে (Allende) সরকারের রক্তাক্ত পরিণতি এই বিষয়কে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক স্তরেও এমন ঘটনা বার বার দেখা গেছে—সে ১৯৫৯ সালে কেরালাতেই
হোক বা যুক্তফ্রন্ট আমলের পশ্চিমবঙ্গেই হোক।
ভারতের কম্যুনিস্ট আন্দোলনেও সশস্ত্র সংগ্রামের [এবং কিছু
রণনীতিগত] প্রশ্নকে ঘিরে বিবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। ’৪৮ সালের বিটি
রণদিভের সংযুক্ত অভ্যুত্থানের লাইন ও তার সমকালীন তেলেঙ্গানার পার্টিজান যুদ্ধ এর
মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ’৬-এর দশকের শেষ ভাগে ভারতের কম্যুনিস্ট আন্দোলনে যে
নকশালপন্থী ধারার জন্ম হয়েছিল, তাও এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তেলেঙ্গানায় অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টি যে চিনা মডেল অনুসরণ করে, তারই
উত্তরসাধকরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন নকশালপন্থীরা। বলা বাহুল্য, অন্ধ অনুকরণ নয়,
দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী তার সৃজনশীল বিকাশের কথা বলেছিলেন চারু মজুমদার। কিন্তু ’৭২
সালে তাঁর শহীদ হওয়া এবং সিপিআই (এম-এল)-এর বিভিন্ন ভাগে ভেঙে যাওয়ার কারণে দেশে
সশস্ত্র কম্যুনিস্ট আন্দোলন বহু দিন ধ’রে সেভাবে দানা বাধতে পারে নি; সীমাবদ্ধ হয়ে
পড়েছিল ছোট ছোট পকেটে।
যাইহোক, নতুন সহস্রাব্দে কয়েক দশকের এই স্থিতাবস্থা কাটিয়ে
সিপিআই (মাওবাদী)-র জন্ম হয়েছে। দেশের প্রান্তে প্রান্তে তাঁরা ছড়িয়ে পড়েছেন। কিছু
জায়গায় তো তাঁদের শক্তি সমাবেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতন। বিহারে, ঝাড়খণ্ডে,
উড়িষ্যায় বা ছত্রিশগড়ে বহুজাতিক হাঙরদের দাপটে জীবন-জীবিকা হারানো মানুষ ইতিমধ্যেই
মাওবাদীদের সাথে যোগ দিয়েছেন। জল-জঙ্গল-জমি-জীবিকার আন্দোলন ক্রমশ উন্নীত হয়েছে
রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সংগ্রামে। সিপিআই-সিপিআই (এম)-এর মত একেবারে রাষ্ট্রের পুশ্যি
না হলে, কোনও কম্যুনিস্ট নামধারী গোষ্ঠী শোষিত মানুষের এই অস্ত্রধারণের বিরোধিতা
করছে না। গান্ধীজী একবার বলেছিলেন, কাপুরুষতা এবং হিংসার মধ্যে বেঁছে নিতে হলে
শেষেরটাই বাছা উচিৎ। তাই, যখন আদিবাসী ও খেটে খাওয়া জনতার উপর আন্তর্জাতিক
বেনিয়াকুল ও তাদের দালালচক্রের আক্রমণ উত্তুঙ্গ, তখন সশস্ত্র প্রতিরোধটাই পথ।
কিন্তু প্রদীপের নিচেই তো অন্ধকার জমাট বেঁধে থাকে। নয়া-উদারনীতি
ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে মাওবাদীরা যেমন নকশালবাড়ির
ধারাবাহিকতার পরিচয় দিচ্ছেন, তেমনই তাঁদের আন্দোলন এর অপবিকৃতিও ঘটাচ্ছে। যেকোনো
লড়াইকে কুক্ষিগত ক’রে নিজেদের সর্বগ্রাসী শাসন (totalitarian
rule) কায়েম করতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কর্মীদের
নির্বিচারে হত্যা করতেও তাঁদের হাত কাঁপছে না। উড়িষ্যার রায়গদা জেলার বন্ধুগাঁওতে
‘চাষি মূল্য আদিবাসী সংঘ’-এর নেতা ও সিপিআই (এম-এল) ক্যাডার কেন্দ্রুকা অর্জুনের
হত্যা এই অভিযোগের জ্বলন্ত প্রমাণ। শ্রীকাকুলাম ও রায়গদা-কোরাপুটের মাঝের ৪০০-টা
গ্রামে নিজেদের সংগঠন বাড়াতে তাঁরা অর্জুনকে নৃশংসভাবে খুন করেন। এতেই শেষ নয়,
তাঁরা এও প্রচার করেন যে, অর্জুন ছিল পুলিশের চর।
পশ্চিমবাংলার লালগড়ে আদিবাসী জনতার যে লড়াই তৈরি হয়েছিল তাও
মাওবাদীদের কল্যাণে নিছক সন্ত্রাসবাদী গতিপথে ধ্বংস হয়েছে। ফিউদতন্ত্রের সবচেয়ে
পচনশীল অংশের সাথে হাত মিলিয়ে তাঁরা বিতাড়িত করেছিলেন বাকি সমস্ত সংগ্রামী দলকে,
যাতে লালগড়ে একাধিপত্য কায়েম করা যায়। পিসিসি নেতা সন্তোষ রানার সেই সময়কার একটা
প্রেস বিবৃতি থেকে জানা যায় কীভাবে মাওবাদী নেতৃত্ব অন্য দলের বামপন্থী ও
দেশপ্রেমী কর্মীবাহিনীকে ভয় দেখিয়ে, খুন ক’রে এলাকায় এলাকায় বল্গাহীন সন্ত্রাস
ক’রে বেড়িয়েছেন। চারু মজুমদার একদা তাঁর কোনও এক কমরেড-কে লিখেছিলেন— যে সব জায়গায়
লড়াই হচ্ছে বা হবে, তাতে সর্বত্রই যে তাঁরা উপস্থিত থাকবেন বা তাঁদের পার্টির
নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, তা নয়। সংগ্রামের ময়দানে গণতান্ত্রিক বোঝাপড়ার উপরেই
নির্ভর করার কথা বলেছিলেন তিনি। কিন্তু মাওবাদীরা চারুবাবুর ভুল সংশোধনের নামে
তাঁর শিক্ষাগুলোকেই জলাঞ্জলি দিয়েছেন।
শ্রেণীর প্রশ্নও বার বার উপেক্ষিত হয়েছে মাওবাদীদের কাছে।
নকশালবাড়ির মূল কথাই ছিল শ্রমিকশ্রেণীর পরিচালনায় দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের
নেতৃত্বে মধ্য কৃষকের সাথে ঐক্যসাধন এবং ধনি কৃষকের একাংশের নিষ্ক্রিয়করণ। কিন্তু
লালগড়ে আমরা কী দেখলাম? শুধুমাত্র সিপিআই (এম) ক্যাডার হওয়ার অপরাধে চারশতাধিক
গরিব কৃষক ও খেতমজুরের হত্যা, তাঁদের সন্তানদের হাতে প্ল্যাকার্ড ধড়িয়ে দেওয়া—‘আমার
বাবা আর সিপিএম করবে না’। কী অসামান্য সংশোধনবাদ বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রাম!
মাওবাদীরা হামেশাই দাবী করেন যে তাঁরা চারু মজুমদারের খতমের
লাইন পরিত্যাগ করেছেন কারণ তার মধ্যে নাকি শ্রেণী লাইন বর্জিত ব্যক্তি-সন্ত্রাসবাদের
বীজ লুকিয়ে আছে। তাই যদি হয়, তাহলে মাওবাদীদের এই indiscriminate
killing-এর অর্থ কী? প্রকৃত অর্থে, চারু মজুমদারের খতম লাইন কোনও
সন্ত্রাসবাদী বিচ্যুতি ছিল না। তাঁর বক্তব্য ছিল—খতম হ’ল শ্রেণী সংগ্রামের উচ্চতর
রূপ এবং গেরিলা যুদ্ধের সূচনা; এর মানে শুধু একটা লোককে শারীরিকভাবে সাবাড় ক’রে
দেওয়া নয়, খতমের লক্ষ্য সামন্তী ও মহাজনদের, তথা সাংস্কৃতিক hierarchy-র, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তির উচ্ছেদ বা বিলুক্তিসাধন।
শ্রেণীর প্রশ্নে তিনি এতটাই অনমনীয় ছিলেন যে একবার এক কমরেডকে লিখেছিলেন—‘অ্যাকশন
আপনা-আপনি শ্রমিকদের চেতনা উন্নত করবে না। কিছু দিন তাই খতম অভিযান বন্ধ থাকলে
কোনও ক্ষতি নেই। আপনারা শ্রমিকদের রাজনীতি দিয়ে সচেতন করুন’। তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ
ছিল যাতে কোনও সংগঠক আদিবাসী বা ভূমিহীন খেতমজুর বা প্রান্ত্রিক চাষির, তা তিনি
যতই বিরোধিতা করুন, গায়ে হাত না দেয়। সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি যাতে পার্টিকে না গ্রাস
করতে পারে, তার জন্য চারু মজুমদারের বলেছিলেন ভূমিহীন এবং দরিদ্র কৃষককে সমগ্র
রাজনীতির কথা বলতে, যাতে তিনিই ঠিক করতে পারেন খতম করবেন না অন্য কোনও সংগ্রাম
পরিচালনা করবেন। তাঁর মতে, শুধু শ্রেণী শত্রু খতমের কথা বলা মানে অর্থনীতিবাদ। মাওবাদী
আন্দোলনে এই শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গির জায়গাতেই একটা বিরাট ফাঁক থেকে গেছে।
শ্রেণীর মানুষের উপর নির্ভর না করার কারণেই তাঁদের আমদানি
করতে হয়েছে জঙ্গল-পাহাড় কেন্দ্রিক গেরিলা যুদ্ধের লাইন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও
চিন্তাধারা ও চারু মজুমদারের রাজনীতি এই শিক্ষাই দেয় যে, জনগণ হলেন জলের মতন,
বিপ্লবীরা মাছের মতন। জল ছাড়া মাছ বাঁচে না। অর্থাৎ জনগণের উপর নির্ভর না ক’রে
তথাকথিত safe terrain বেঁছে নিলে অস্ত্রের উপর
নির্ভরতা বারে এবং রাজনীতি পিছনে চলে যায়। অসীম চ্যাটার্জীরা যখন এই একই প্রস্তাব
(জঙ্গল-পাহাড় কেন্দ্রিক লড়াইয়ের প্রস্তাব) পার্টি কেন্দ্রের কাছে রেখেছিলেন, তখন চারু
মজুমদারকে এর বিরোধিতায় নেমে বোঝাতে হয়েছিল যে, নিজের শক্তির সমাবেশ ঘটাতে হলে বা
তাকে রক্ষা করতে হলে জনগণ ছাড়া আর কারো উপর নির্ভর করা চলে না। চারু মজুমদারকে সংশোধন
করতে গিয়ে বর্তমানের মাওবাদীরা হয়ে পড়েছেন অসীম চ্যাটার্জীর দেওয়া ১৯৭১ সালের thesis-এর দৃঢ় অনুগামী মাত্র। সমতলে তাই তাঁদের সেরম কোনও উপস্থিতিই নেই।
মাওবাদীদের অনুসৃত পথ যে নকশালবাড়ি অনুসৃত পথের বিপ্রতীপে,
তা হয়ত আর না বললেও চলে। তাঁরা মুখে বলেছেন নকশালবাড়ি ও সমাজতন্ত্রের কথা, এদিকে
কার্যক্ষেত্রে সেটাই হয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসবাদ। বিপ্লবী সংগ্রামের নামে জন্ম হচ্ছে
ব্ল্যাঙ্কিবাদের ছোপ লাগা সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির। একে এক কথায় বলা যায় ‘সামাজিক
সন্ত্রাসবাদ’।
এর আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সর্বগ্রাসী মানসিকতা কাটিয়ে
উঠতে হবে, হতে হবে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। এছাড়াও ভারতীয় সমাজের
দ্বন্দ্বগুলোকে আরও ভালোভাবে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে এই সত্য যে, জোর ক’রে মানুষকে
দিয়ে কিছু করানো যায় না; না নির্বাচন বয়কট, না বিপ্লব। নির্বাচন সম্বন্ধে তাঁদের
যে মোহ, তার বিরুদ্ধে ধৈর্য সহকারে রাজনৈতিক প্রচার না চালালে কোনদিনই মানুষের
সাথে একাত্ম হওয়া যাবে না। সর্বোপরি, হৃদয়ের প্রসারতা আনতে হবে, কারণ ‘জনগণের
স্বার্থই পার্টির স্বার্থ’।
বেশ লেগেছে পড়তে। এগুলো নিয়ে আরো আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
ReplyDeleteভালো লাগল লেখাটা!
ReplyDelete