Man's dearest possession is life. It is given to him but once, and he must live it so as to feel no torturing regrets for wasted years, never know the burning shame of a mean and petty past; so live that, dying he might say: all my life, all my strength were given to the finest cause in all the world- the fight for the Liberation of Mankind. - Nikolai Ostrovsky

Thursday, July 21, 2011

রেজিমেন্টেশন, গণতান্ত্রিক বাম এবং আরও কিছু (দ্বিতীয় পর্ব) - পর্যবেক্ষক ('এই তো সময়' প্রথম বর্ষ ষষ্ঠদশ-সপ্তদশ যৌথ সংখ্যা এবং অষ্টদশ-উনবিংশ যৌথ সংখ্যা, ২১শে জুলাই, ২০১১)



সামরিক বিজ্ঞানের অবিধানে একটা কথা আছে— ‘battle of attrition’ এই যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্যবিভিন্ন দিক থেকে মুহুর্মুহুর আঘাত হেনে শত্রুপক্ষের যোদ্ধাদের এক জায়গায় আটকে রাখা ও রসদের যোগান তলানিতে নিয়ে গিয়ে তাদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দেওয়া এবং শেষে তাদের একদম নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে এইটাই করতে নেমেছে সাম্রাজ্যবাদী লুটেরা আমেরিকা। এই কাজে তার সবচেয়ে বড় সহযোগী সেই কর্পোরেট লিপিকারের দল যারা বামপন্থীর ভেক ধরতে সিদ্ধহস্ত। আগের অংশে (যা গত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে) এদেরই একজনের জোচ্চুরি নিয়ে বিষদে আলোচনা করা হয়েছে। কম্যুনিস্ট পার্টিকে তিনি কিভাবে একটা গণ-অর্থনৈতিক গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করার তাল করছেন, সেটাও পরিষ্কার ভাবে দেখানো হয়েছে। এখন, তিনি কেমন ভাবে পার্টির ভেতরের কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইছেন, সেটাই আপনাদের সামনে আমরা তুলে ধরবো।
অতি-কৌশলী এই প্রাবন্ধিক প্রচুর মাথা খাটিয়ে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার চারসূত্রী নির্দেশিকাকে আক্রমণ করেছেন, এবং গণতন্ত্রকে উপায়েরবদলে লক্ষ্যহিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার বদমায়েশি করেছেন। গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা উভয়ই যেহেতু উপরিকাঠামো থেকে উদ্ভুত, সেহেতু এরা রাজনীতিরই অংশ এবং অর্থনৈতিক ভিত্তির সেবক। মাও-এর বিশ্লেষণে, ‘গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা দুই-ই হচ্ছে আপেক্ষিকঅনাপেক্ষিক নয়, এবং নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক অবস্থার মধ্যেই এদের উদ্ভব ও বিকাশ...। কিন্তু এই সত্য উচ্চারণ থেকে লেখক মশাই বিরত থেকেছেন। ধূর্ত বুর্জোয়া উকিলের মতো তিনি ঘুটি সাজিয়েছেন বেশ চাতুর্যের সাথে, যাতে বিপ্লবী জনগণ তাঁর কলার চেপে ধরলে তিনি সহজে সব অভিযোগ অস্বীকার করতে পারেন। কিন্তু বাপেরও তো বাপ থাকে! বিপ্লবীমশাই শুধুই ঘুঘু দেখেছেন, ফাঁদ তো দেখেনি!
অল্প কথায় বললে, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার পয়েন্টগুলো হ— (১) ব্যক্তি সংগঠনের অধীন, (২) সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর অধীন, (৩) নিম্নতর স্তর উচ্চতর স্তরের অধীন এবং (৪) সমগ্র পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন। বামপন্থী মাত্রেই জানেন, এগুলো কোনও সাধারণ সাংগঠনিক নির্দেশিকা নয়, আন্তর্জাতিক বিপ্লবী অভিজ্ঞতার মতাদর্শগত ফসল। এই সূত্রাবলীর বিরোধিতা করলে আদতে শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রণী সংগঠন একটা ডিবেটিং সোসাইটি-তে অধঃপতিত হয়। আমাদের মহানপ্রাবন্ধিক যে এটা জানেন না তা নয়। কিন্তু তার পরেও কেন তিনি এর বিরুদ্ধে কলম শানাচ্ছেন, এটা বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে তাঁর অতীত জীবনের কিছু ঘটনা। সেগুলো জানার পরেই আমরা কম্যুনিস্ট পার্টির সভ্যদের সাথে তার নেতৃত্বের সম্পর্কের বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করবো।
১৯৬৭ সালের ২৪শে মে। উত্তর বাংলার নকশালবাড়ীর কৃষক অভ্যুত্থান হাজির হল বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের মতো। সর্বস্তরের মানুষের মনে তা নাড়া দিল। শ্রমিক, কৃষকের সাথে সাথে বিপ্লবী যুব-ছাত্ররাও জীবন পণ করে নেমে পড়ল সংগ্রামের ময়দানে। কলকাতার কলেজগুলো হয়ে উঠল শহরের বিপ্লবী আন্দোলনের আঁতুড়ঘর। কিন্তু সারা পৃথিবীর সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কম্যুনিস্ট আন্দোলন শুধু ডাক্তার জেকিল তৈরি করে না, মিস্টার হাইড-ও সৃষ্টি করে। ছাত্র আন্দোলনের আঙিনায়ও ঠিক একই ভাবে জন্ম হল একদল ইগোইস্ট আগুনখেকোর। তাদেরই প্রথম সারির একজন হলেন আজকের এই গণতান্ত্রিক বামবুদ্ধিজীবী। ২৬ বছর বয়েসে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। চারু মজুমদার তখন বিপ্লবী জনতার অবিসংবাদী নেতা। কমিটির সদস্য হয়েই আমাদের লেখক মশাই ঘোষণা করেছিলেন— ‘যদি কেন্দ্রীয় কমিটি এক দিকে যায় এবং চারু মজুমদার আরেক দিকে, তাহলে আমি চারু মজুমদার-কেই অনুসরণ করবো!একথা শুনে চারুবাবুর অন্তরঙ্গ সহযোদ্ধা সরোজ দত্ত শেল্টার-এ ফিরে হাসতে হাসতে বলেন, ‘ওটাই সবার আগে পালাবে...। ইতিহাস সরোজবাবুকে সঠিক প্রমাণ করেছে। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতিকে অস্বীকার করে, কেন্দ্রীয় কমিটির মূল্যায়নকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে নিজের মতকে প্রাধান্য দিয়ে পার্টির সংকটের সময়ে উপদলীয় চক্রান্ত করে সিপিআই(এমএল)-কে দুটুকরো করে দেওয়ার কাজ করেছিলেন আজকের এই কর্পোরেট কলমচি। আজকাল যদিও বড় মুখ করে বলে বেরান, ‘split by itself is not a virtue’, কিন্তু তাতে কি আর অতীতের নোংরামো ছাইচাপা থাকে? চরম হঠকারী পথ গ্রহণ করে সম্পূর্ণ আমলাতান্ত্রিক-ভাবে ১২০জনকে শ্রেণীশত্রু ও খোঁচর আখ্যা দিয়ে হত্যা করা (খবর পেয়ে অসুস্থ চারু মজুমদার উত্তেজিত হয়ে বলে উঠেছিলেন, ‘are we a party of butchers!’), অথবা বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বর্বরদের সমর্থন যোগানোর জন্য পার্টির শৃঙ্খলা না মেনে স্বাধীনভাবে লিফলেট বিলি করা এসবই তাঁর অতুল কীর্তি। তাই তিনি যে শৃঙ্খলা বর্জিত ঢিলেঢালা সংগঠন তৈরির দাবী জানাবেন তাতে আর অবাক হওয়ার কি আছে!
পার্টির ভেতরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য পার্টি-শৃঙ্খলাকে মজবুত করা, তার লড়াকু মেজাজকে বাড়িয়ে তোলা। উচ্ছৃঙ্খলতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার নাম গণতন্ত্র হতে পারে না। পাতি বুর্জোয়া-বিপ্লববাদে বিশ্বাসী কারোর পক্ষে এটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, কারণ এরা রাজনৈতিক চেতনার চেয়ে অনেক বেশী নির্ভর করেন স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর। এতে ভাটা পড়লে মওকা বুঝে কোনও কর্পোরেট হাউজ-এ ঢুকে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটার ভান করেন, গরম বুলি ঝাড়েন। হৃদয়ের গভীরে লাব-ডাব’-এর বদলে আওয়াজ ওঠে— ‘ডলার, ডলার...। তবে এই মুহূর্তে এবিষয়ে আমাদের রুচি নেই। ব্যক্তিজীবন রাজনৈতিক জীবনের অঙ্গ হলেও, তা আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। এখন আমাদের কাজ, এই বুদ্ধিজীবীর তাত্ত্বিক ভণ্ডামির মুখোশটা খুলে দেওয়া।
গণতান্ত্রিক বামপন্থার ধ্বজা উড়িয়ে এই বাজারি বিপ্লবীরীতিমতো সার্কাসী দড়ির খেল দেখিয়েছেন। এক যায়গায় তিনি লিখেছেন— ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নামে আসলে কেন্দ্রিকতাটাই অনুশীলিত হয়েছে। সংখ্যালঘুর বা নিম্নস্তরের বক্তব্য প্রায় সকল সময়েই অবদমিত থেকেছে...। তিনি আরও বলেছেন, সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু ভেদটাও ঠিক নয়, কারণ সত্য প্রাথমিক ভাবে অল্প মানুষের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। চমকে ওঠার মতোই কথা! সত্যিই তো! স্তালিন-পরবর্তী সোভিয়েত-এর অভিজ্ঞতাও তো একই! তাহলে তো বলতে হয় ঠিকই বলেছেন! কিন্তু তাই কি? না, তা নয়। মার্কসবাদ শেখায় সবকিছুকে পূর্ণতায় বিচার করতে, আংশিক ভাবে নয়। আলোচ্য লেখায় এবং অন্যান্য প্রবন্ধে তিনি যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাতে পরিষ্কার যে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি প্রয়োগ হলে তার বিকৃতি ঘটবেই। শৃঙ্খলা মানার তাগিদে সংখ্যালঘুর মত চাপা পড়ে যাবে, নিয়মের ফাঁসে জড়িয়ে আমলাতান্ত্রিক সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে উঠবে।
এটা সত্যের অপলাপ। কৌশলে লেনিনবাদী সাংগঠনিক নীতিকে ছোট করার অপচেষ্টা। লৌহদৃঢ় শৃঙ্খলা ছাড়া কোনও প্রকৃত বিপ্লবী পার্টি গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। ঢিলেঢালা সংগঠনের ক্ষমতা নেই বিপ্লবী সংগ্রামে জয়ী হওয়ার। তবে এই শৃঙ্খলা আকাশ থেকে পড়ে না। এটা তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যখন তিনটে বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হয় ‘(১) কম্যুনিস্ট পার্টির শ্রেণীচেতনা, বিপ্লবের প্রতি আনুগত্য ও অধ্যবসায়, আত্মত্যাগ ও বীরত্ব; (২) ব্যাপক সর্বহারা শ্রমিক ও অ-শ্রমিক জনগণের সঙ্গে নিবিড় সহযোগ স্থাপনে যোগ্যতা; (৩) রণনীতি ও রণকৌশল এবং তার নির্ভুলতা সম্পর্কে জনসাধারণের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত বোধ।লেনিন বলছেন— ‘এই অবস্থাগুলো তৈরি না হলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার সমস্ত চেষ্টাই অবধারিতভাবে ধুলোয়ে মিশে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হবে শুধুই বুলিবাজি এবং মুখ ভেংচিতে। অতএব, পার্টির অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা মানে রাজনৈতিক কাজের সাংগঠনিক রূপ। পার্টি সভ্যদের মধ্যে মৌলিক মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক স্তরে ঐক্য না থাকলে, শ্রমিকশ্রেণীর ও অন্যান্য জনগণের সাথে প্রাণবন্ত যোগাযোগ এবং শ্রেণী সংগ্রামের জীবন্ত দৃষ্টান্ত না থাকলে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা লাগু করা যায় না, যেতে পারে না। তার বদলে যেটা দেখা দেয় তা হল অতিকেন্দ্রিকতা। এটা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার অবধারিত ফলশ্রুতি নয়, বিকৃতি।
কম্যুনিস্ট পার্টির অন্যতম দুটো শৃঙ্খলা হ— ‘সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর অধীনএবং নিম্নতর স্তর উচ্চতর স্তরের অধীন কোনও সিদ্ধান্ত ভোটাভুটির মাধ্যমে পাশ হলে সেক্ষেত্রে সংখ্যালঘু-কে সংখ্যাগুরুর মত মেনে নিতে হবে, মতের তফাত থাকা সত্ত্বেও কার্যক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সমর্থন করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু এর মানে মোটেও এমনটা নয় যে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে তাকে বাধা দেওয়া হবে। লেনিন নিজে বহুবার সঠিক হওয়া সত্ত্বেও পরাজিত হয়েছেন। মাও-এর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তাঁরা কেওই পার্টির লৌহদৃঢ় শৃঙ্খলাকে লঙ্ঘন করেননি। পার্টির ভেতরেই লড়াই চালিয়েছেন, সংগ্রামের মাধ্যমে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ক্রেমলিন সামরিক স্কুল-এর লেনিন-স্মরণ সভায় প্রদত্ত ভাষণে স্তালিন বলেছিলেন পার্টির সংখ্যাধিক্যের সমর্থন লাভ করাকে পার্টি-নেতারা যথেষ্ট লোভনীয় বলে মনে করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা এমনই এক শক্তি যা একজন নেতা হিসেবের মধ্যে না ধরে পারেন না। পার্টির অন্যান্য নেতাদের থেকে এটা লেনিন নেহাত কম বুঝতেন না। কিন্তু তিনি কখনও সংখ্যাগরিষ্ঠতার হাতে বন্দী হননি, বিশেষ করে, যখন সংখ্যাধিক্যের কোনও নৈতিক ভিত্তি থাকত না। আমাদের পার্টির ইতিহাসে এমন সময়ও এসেছে যখন সংখ্যাগুরুর মতের সাথে বা পার্টির সেই মুহূর্তের স্বার্থের সাথে সর্বহারার মৌলিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এইরকম অবস্থায় লেনিন কোনোদিন বিচলিত হননি; দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছেন নীতির পক্ষে ও সংখ্যাগরিষ্ঠের বিপক্ষে। অধিকন্তু, কিছু কিছু সময়ে, এই বিচার করে যে, ... নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত কর্মনীতিই সঠিক, তিনি সবার বিরুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে একা দাঁড়াতেও ভয় পেতেন না।লেনিনবাদ শেখায়, সংখ্যাগুরুর মতেরও সমালোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা একটা পদ্ধতি মেনে করা উচিৎ তা না হলে শ্রমিকশ্রেণীর প্রধান শ্রেণী সংগঠনের সাথে একটা বিতর্ক সভার কোনও পার্থক্য থাকে না। পার্টির কর্মসূচী ও গঠনতন্ত্রের আওতায় থেকেই তা করতে হয়। আবার লেনিনবাদ এও বলে যে, পার্টি নেতৃত্ব যদি দুর্নীতির আবহাওয়ায় শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে থাকে তাহলে প্রতিবাদ করাই শ্রেয়। তাতে একা হলেও ভয় পেলে চলবে না, কারণ জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ
পার্টির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের প্রতি যদি কোনও নিম্নতর কমিটির আপত্তি থাকে, তাহলে সেও নিজের মত বলিষ্ঠভাবে জানাতে পারে, তাতে যদি কোনও আদর্শগত বিচ্যুতি থাকে, তাকে ঠিক করার জন্যে লড়াইও চালাতে পারে। তাই রোজা লুক্সেমবার্গ যেমনটা অভিযোগ করেছেন, ‘The central committee would be the only thinking element in the party’, তেমনটা মটেও বাস্তব-সত্য বলে বিবেচনা করা যায় না। একবার যদি কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোনও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তাহলে পার্টির সমস্ত সদস্যকে তা মেনে কাজ করতে হবে, কিন্তু সেই সাথে নিজের মত প্রকাশের অধিকারও থাকবে। সমালোচনার স্বাধীনতা ও কাজের ঐক্যশীর্ষক রচনায় লেনিন দেখিয়েছেন পার্টি নেতৃত্বের সমালোচনা করার সীমানা কতোটা হতে পারে। তিনি স্পষ্ট বলেছেন— ‘পার্টি কর্মসূচীর নীতিসমূহের সীমানার মধ্যে অতি অবশ্যই সমালোচনা করার অবাধ অধিকার থাকতে হবে। কেবলমাত্র পার্টি-সভায় নয়, জনসভাতেও সমালোচনা করার পূর্ণ অধিকার থাকতে হবে। এধরনের সমালোচনা বা অ্যাজিটেশন (কারণ সমালোচনাকে অ্যাজিটেশন-এর থেকে আলাদা করা যায় না) কোনও মতেই নিষিদ্ধ করা যেতে পারে না... যতক্ষণ না একটা নির্দিষ্ট কাজে ঐক্যবদ্ধ কর্মশক্তি প্রয়োগে তা বাধা হয়ে না দাঁড়ায়...
কাজের ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, এমন আহ্বান কখনোই সহ্য করা করা উচিৎ নয়। না পার্টি সভাতে, না জনসভাতে। এই বক্তব্যের সমর্থনে লেনিন একটা সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন— ‘পার্টি কংগ্রেসে ঠিক হল যে পার্টি ডুমা ইলেকশন-এ অংশগ্রহণ করবে। নির্বাচনে লড়াই করা একটা অত্যন্ত নির্দিষ্ট কাজ। [তাই] ইলেকশন-এর সময়ে কোথাও কোনও পার্টি কর্মীর অধিকার নেই জনগণকে ভোটদান থেকে বিরত থাকতে বলার। সেই সময় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের কোনও সমালোচনাবরদাস্ত করা হবে না। কেননা, এতে প্রকৃত পক্ষে নির্বাচনী সাফল্য বিপন্ন হবে। ইলেকশন ঘোষণা হওয়ার আগে যদিও সর্বস্তরেই পার্টি সদস্যদের পরিপূর্ণ অধিকার থাকবে এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করার...
পার্টির মৌলিক রাজনৈতিক-সাংগঠনিক লাইন নিয়েও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। পার্টি কংগ্রেসে যে লাইন সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট পেয়ে পার্টি-লাইন হিসাবে উঠে এসেছে তাকে প্রশ্ন করা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতায় স্বীকৃত। আমাদের গণতান্ত্রিক বামপন্থীলেখকের পার্টি থেকেই একটা বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যাক। অবিভক্ত সিপিআই (এম-এল)-এর কর্মসূচী অনুযায়ী ভারতের বুর্জোয়া শ্রেণী প্রধানত মুৎসুদ্দি চরিত্রের, এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী এখানে এতোটাই দুর্বল যে তাদের প্রতি আলাদা গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রচরিত্র নির্ধারণের কোনও মানে হয় না। কিন্তু ১৯৭০-এর মার্চ মাসের পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত এই লাইন-কে কয়েক মাস পরেই, যুব-ছাত্র আন্দোলনের পর্যালোচনা করতে গিয়ে, চ্যালেঞ্জ করেন দলের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য সুশীতল রায় চৌধুরী (টেক নাম পূর্ণ’)। সুশীতলবাবুর দলিলের জবাবি ভাষণ দিতে উঠে পার্টির সাধারণ সম্পাদক চারু মজুমদার বলেন— ‘কমরেড পূর্ণর লেখা পড়ে মনে হচ্ছে যে, পার্টির বর্তমান রাজনৈতিক-সাংগঠনিক লাইনের বহু দিক সম্পর্কে তাঁর দ্বিধা আছে। পার্টি কংগ্রেস হয়েছে বলেই কেউ এগুলি পুনরুত্থাপন করতে পারবেন না, এমন কোনও কথা নেই। কারণ পার্টির নীতিকে বাস্তবে যখন রূপ দেওয়া হয় তখন বহু বিষয় চোখের সামনে আসে যেগুলো হয়তো তত্ত্বগত আলোচনার সময় নজরে পড়ে না। এই সব মতবিরোধের উপর রাজনৈতিক আলোচনা পরিচালনার মারফৎ-ই পার্টি সভ্যদের রাজনৈতিক জ্ঞান গভীর থেকে গভীরতর হয় এবং কোনটি সঠিক, কোনটি বেঠিক তাঁর নির্দিষ্ট সীমারেখা টানা যায়’ (জোর আমার)।
শুধুমাত্র সুশীতলবাবুর ক্ষেত্রেই নয়, তৎকালীন সিপিআই (এম-এল) নেতৃত্ব আমাদের আজকের মহান গণতান্ত্রিক বামপন্থীমশাইয়ের দলিল দুটোও একেবারে ওপরতলা থেকে নিচুতলা অবধি প্রচার করেছিলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ‘কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যে কোনও প্রস্তাব গৃহীত হোক, সেটি সারা দেশে প্রচার করা হবে যাতে [সদস্যদের] উপলব্ধি (understanding) আরও ভালো হয়। আলাপ আলোচনার পরে যখন সর্বস্তরের কমরেডরা দলিল দুটো ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, তখন পার্টি-শৃঙ্খলাকে স্বীকার করে কাজ করার বদলে গণতন্ত্রের জাবরকাটা এই বুদ্ধিজীবী বেঁছে নিলেন পার্টি-বিরোধী কুৎসার পথ। লিফলেট বার করে পার্টি নেতৃত্বকে গাল পাড়লেন ভারতীয় ওয়াং মিং ও তার অনুচরলে। জীবনের শুরু থেকেই যে মানুষ ইগোইস্ট উচ্ছৃঙ্খল, সে কিভাবে টিকবে একটা শৃঙ্খলাপরায়ণ দলে?
রেজিমেন্টেশনের বিরোধিতার নামে লেখক লেনিন-এর বিরুদ্ধে যে জেহাদ ঘোষণা করেছেন, তার উৎসের শিকড় রীতিমতো গভীর এটা আমরা আজ পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পেরেছি। চিনে ফেলেছি বামপন্থার মুখোশ আঁটা কর্পোরেট দালাল-কে।
যাইহোক, বিষয়টা যখন গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’, তখন আরও দু-তিনটে প্রসঙ্গ গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হওয়া উচিৎ
অনেকে মনে করেন, ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতামানে রাজনৈতিক ভাবে বিতর্ক চালানো, এমনকি রাজনৈতিক ভিন্নতা, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত কেন্দ্রিকতা। কাজের ঐক্য এবং কেন্দ্রিকতাএই দুটো শব্দের মধ্যে যে মৌলিক তফাত রয়েছে, তা তারা অনেক সময় ধরতে পারেন না। লৌহ দৃঢ় অনুশাসন অনুসরণ করার মানে প্রতিটা কাজের জন্য কেন্দ্রীয় বা রাজ্য নেতৃত্বের দিকে আদেশ পাওয়ার অপেক্ষায় চেয়ে থাকা নয়। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাসাধারণ রাজনৈতিক লাইন কেন্দ্রীভূত বা সেন্ট্রালাইজডহয়। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে, বিভিন্ন এলাকার অসম বিকাশ এবং তার নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ও ভৌগলিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কর্মধারা পালটে পালটে যায়। বিপ্লবী কে? বিপ্লবী হচ্ছে সেযে সমস্যা দেখে অন্যের কাছে ছুটে যায় না, নিজেই তা সমাধান করার চেষ্টা করে ও নেতৃত্ব দেয়। একজন পার্টি সদস্য যদি অবস্থা বুঝে স্বাধীন উদ্যোগ গ্রহণ করতে না পারেন, তাহলে তিনি নিতান্তই খুঁটোয় বাঁধা গরু, বিপ্লবী নন। মৌলিক রাজনৈতিক লাইন (মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-মাও চিন্তাধারা)-এর প্রতি আস্থা রেখে কোনও বিশেষ অবস্থাকে বাস্তবের মাটিতে নেমে বুঝতে হয় এবং সেই অনুযায়ী রাজনীতিকে রূপ দিতে হয়। অর্থাৎ, রাজনীতি কেন্দ্রীভূত, প্রায়োগ বিকেন্দ্রীভূত
কেন্দ্রীভূত রাজনীতি সম্পর্কে অনেকে আবার সন্দিহান। তারা মনে করেন, এর মানে আলাপ-আলোচনা না করে চাপিয়ে দেওয়ার নীতি। বলা বাহুল্য, এটা একটা ভুল চিন্তা। পার্টির ভেতরে আলোচনার সব রকম সুযোগ থাকে। পার্টির সাধারণ লাইন-ও আলাপ আলোচনা এবং প্রয়োগের ভিত্তিতেই বিকশিত হয়। এই গুণ না থাকলে কম্যুনিস্ট পার্টির মৌলিক নীতি নির্ধারণে বিচ্যুতি ঘটতে বাধ্য। জীবন্ত অধ্যয়ন কম্যুনিস্ট পার্টির প্রাণ-ভোমরা। এর প্রধান দিক দৃঢ়তা ও নমনীয়তার সংযুক্তি ঘটানো (combination of firmness and flexibility) কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্যে যে আলোচনা হবে, তাতে সব রকমের মত শোনার এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করার ব্যাপারে নমনীয় হতে হবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে তখন সেটাকে দৃঢ়ভাবে প্রয়োগে নিয়ে যেতে হবে। প্রয়োগে গিয়ে যদি দেখা যায় নতুন নতুন বিষয় উঠে আসছে, তাহলে শৃঙ্খলা মেনে পুনরায় আলোচনা-সমালোচনা করা যেতে পারে। এই বিষয়ে আগে উল্লেখিত সুশীতল রায় চৌধুরী-চারু মজুমদার বিতর্ক একটা আদর্শ উদাহরণ।
আমাদের আলোচনার সর্বশেষ বিষয়রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা ঠিক না বেঠিক? এই প্রশ্ন আমাদের বর্তমান প্রবন্ধের প্রথম এবং দ্বিতীয়, দুই অংশের সাথেই যুক্ত। তাই আমরা এটা একদম শেষে আলোচনা করছি।
১৯৭৭-এ সোভিয়েত ইউনিয়ন-এ যে নতুন সংবিধান লেখা হয়, তার প্রথম অধ্যায়ের তিন নম্বর ধারায় বলা হয়েছিল— ‘সোভিয়েত রাষ্ট্র সংগঠিত হবে এবং কাজ করবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি অনুযায়ী...সিপিআই (এম)-এর সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট-এর মতে এটাই অন্যতম কারণযা সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে’ ‘বিকৃত করেছে। তিনি মনে করেন, ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাকেবলমাত্র পার্টির সংগঠনের জন্যই প্রযোজ্য, সমগ্র রাষ্ট্রের জন্য নয়। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও চিন্তার নিরিখে বিচার-বিশ্লেষণ করে আমাদের মনে হয়েছে এই বক্তব্য পর্যালোচনার দাবী রাখে।
গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা কম্যুনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক নীতি মাত্র নয়, জনগণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রাথমিক পর্বে অস্তিত্বকারী সামাজিক দ্বন্দ্বগুলোকে সামগ্রিক ভাবে আত্মস্থ করে তার থেকে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ করে রাজনৈতিক সংগ্রামে প্রয়োগ করার রাজনৈতিক তত্ত্বও বটে। কোনও কিছুই শুধুমাত্র বিমূর্তভাবে দেখা ঠিক নয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিপরীতের একত্বের নিয়ম হল মৌলিক নিয়ম।
গোটা বিষয়টাকে মাও সেতুং খুব সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর দ্বন্দ্বের সঠিক মীমাংসা...শীর্ষক রচনায়। মাও-এর শিক্ষা অনুযায়ী— ‘জনগণের মধ্যে যা প্রযোজ্য তা হল গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’, কারণ স্বাধীনতা ও শৃঙ্খলা, গণতন্ত্র ও কেন্দ্রিকতা হল একে অন্যের পরিপূরক। এক দিকে তিনি যেমন নাগরিকদের বাক-স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সমাবেশ, সংগঠন, মিছিল, বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতা প্রদান করার পক্ষে, তেমনই, নেতৃত্বযুক্ত স্বাধীনতা এবং কেন্দ্র পরিচালিত গণতন্ত্রেরও পক্ষে। অনেকে ভুল বোঝেন যে, এই ব্যবস্থায় জনতার ভেতরের মতাদর্শগত প্রশ্নগুলোর মীমাংসা করা হয় বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। মাও বলছেন— ‘প্রশাসনিক হুকুমনামা জারী করে বা বল প্রয়োগের রাস্তা অবলম্বন করে যদি মতাদর্শগত বিষয়ের বা ভুল-নির্ভুল নির্ধারণের প্রশ্নের সমাধানের চেষ্টা করা হয় তবে তা কখনও ফলপ্রসূ হবে না, বরং ক্ষতিকরই হবে। ... যেকোনো মতাদর্শগত সমস্যার এবং জনগণের ভেতরকার বিতর্কমূলক সমস্যার মীমাংসা কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেই করা যায়, কেবলমাত্র আলোচনা, সমালোচনা, বুঝিয়ে বলা ও শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি প্রয়োগ করে করা যায়, বাধ্য করার ও চাপ দেওয়ার পদ্ধতিতে নয়
অর্থাৎ মানুষের চেতনার স্তরকে উন্নত করতে হবে গণতান্ত্রিক পথে, আবার তাকে শৃঙ্খলাপরায়ণ জীব হিসাবে গড়ে তুলতে হবে উৎপাদন কার্য়ে। যতদিন যে যেমন শ্রম দেবে, সেই অনুযায়ী ভোগ্যবস্তু লাভ করবে’ – এই নিয়ম চালু থাকবে, ততদিন গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাও বহাল থাকবে। মানুষের চেতনার উন্মেষ ঘটার সাথে সাথে গণতন্ত্র বৃদ্ধি পাবে, কেন্দ্রিকতা শিথিল হবে।
আগের সংখ্যা আমরা সোভিয়েত’-এর উল্লেখ করেছিলাম জনগণের রাষ্ট্র ক্ষমতার একক হিসাবে। সেই সোভিয়েত’-এর উন্নত রূপ হল চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ে গড়ে ওঠা বিপ্লবী কমিটি [যা ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ব্যারাক ক্যু(barrack coup)-এর মধ্যমে বানচাল করে দিয়েছিল পুঁজিবাদের পথগামীরা] এই বিপ্লবী কমিটিই হল জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা অনুশীলন করার সেরা হাতিয়ার। মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের যুগে গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটাকে বিকেন্দ্রীভূত করে, ছোট ছোট বিপ্লবী কমিটি বানিয়ে তাদের হাতে মুদ্রা ব্যবস্থা, বিদেশ নীতি ও প্রতিরক্ষা ছাড়া বাকি সমস্ত কিছুই তুলে দেওয়া হয়েছিল। কায়েম হয়েছিল জনগণের রাজ।
বিপ্লবী কমিটিগুলোর গঠনও এক কথায় অভিনব। এতে অংশগ্রহণকারীরা হলেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। কমিটির নেতৃত্বের তিন ভাগের এক ভাগ আসে জনতার ভেতর থেকে, এবং বাকি দুই ভাগে থাকে আঞ্চলিক পার্টি ও গনমুক্তি বাহিনীর প্রতিনিধিরা। অগ্নিসংযোগ, টাকা তছরুপ এবং ধর্ষণের মতো ঘটনা বাদে পার্টি বা গণবাহিনী কমিটির স্বাধীন কাজের ক্ষেত্রে কখনও হস্তক্ষেপ করে না। জনগণই সব ঠিক করেন। কমিটির চেয়ারম্যান-ও নির্বাচিত হন জনগণের মধ্যে থেকেই। ভারতবর্ষে যদি কখনও বিপ্লবী কমিটির রাজ কায়েম হয়, তাহলে তার চরিত্র ঠিক কী হবে তা এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। চিনের একের ভেতর তিনের মৈত্রী’-কে যান্ত্রিকভাবে অনুকরণ আমরা না-ও করতে পারি। দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আমাদের নিজেদের বিপ্লবী সংগ্রাম ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার মেলবন্ধনেই আমাদের বিপ্লবী কমিটি গড়ে উঠবে। তবে এতে কোনও দ্বিধা বা প্রশ্ন থাকা উচিৎ নয় যে কর্তৃত্বকারী ভূমিকা জনগণই গ্রহণ করবে।
গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা একটা দুমুখো তরোয়ালের মতন। একে ব্যবহার করে যেমন সামাজিক আগাছা উপড়ে ফেলে প্রগতির দিকে অগ্রসর হওয়া যাবে, তেমনই ভুল ভাবে ব্যাবহার করলে নিজের গলাটাই কাটা পড়বে।
এবার শেষ করার পালা। কমরেডস, বাংলার মাটিতে বাম শক্তির সাময়িক পিছু হটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী নরখাদক হায়নাগুলোকে আরও হিংস্র করে তুলেছে। ইতিমধ্যেই ২১ জন শহীদ হয়েছেন। রক্ত নিয়ে চলছে নারকীয় উল্লাস! এই হায়নাগুলোর সেকেন্ড লাইন ডিফেন্স হল গণতান্ত্রিক বামপন্থার ঝুটো তত্ত্ব প্রচারকারীরা। বিপ্লবী জনগণকে সংগ্রামের পথ থেকে সরিয়ে আনাই এদের কাজ। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও চিন্তার ভিত্তিতে সবকিছু বিচার করতে হবে।
কমরেডস, আমাদের ভুললে চলবে না, ‘আমাদের কাজ মানুষকে নিয়ে, যন্ত্র নিয়ে নয়। সেই মানুষের মধ্যে থাকবে ভয়, দ্বিধা, স্বার্থপরতা, তবু সেই মানুষই লড়াই করবে এবং সব কিছুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে তাকে জয় করে হয়ে উঠবে নতুন মানুষ, যে মানুষ হবে নিঃস্বার্থপর, আত্মদানের চেতনায় উদ্বুদ্ধ। বিপ্লবীরাও মানুষ, তাঁরা যন্ত্র নন, তাই তাঁরা মানুষের দুঃখ দেখে কাঁদেন, আর কাঁদেন বলেই তাঁরা পারেন মানুষের দুশমনকে খতম করতে। বিপ্লবীদের মধ্যেও থাকে দ্বিধা, ভয়, দ্বন্দ্ব ও স্বার্থপরতা। কিন্তু লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে তাঁরা এগুলো কাটিয়ে ওঠেন; যারা পারেন না, তাঁরা হয় বসে যান, না হয় প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরে যোগদান করেন। এই সমস্ত কথা মনে রেখেই আমাদের কাজে হাত দিতে হবে। হচ্ছে না বলে হতাশ হলে চলবে না। মানুষ ছোট ছোট লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেই কেবলমাত্র বৃহত্তর লড়াইয়ের দিকে পা বাড়াতে পারেন। তাই লেগে থাকার অর্থই বিজয়’!
ইনকিলাব জিন্দাবাদ!

1 comment: