‘ইন্টেলেকচুয়াল’। বাম
ও কম্যুনিস্ট আন্দোলনে এই বিশেষ প্রজাতির মানুষদের হামেশাই দেখতে পাওয়া যায়। এরা
হয় কোনও না কোনও বিশেষ বিষয়ে ‘পারদর্শী’, নয় উচ্চপদে
চাকুরীরত ‘হোয়াইট কলার’ পেশাদার,
অথবা শিক্ষিত-সম্প্রদায়ভুক্ত পার্টি কর্মকর্তা—মোদ্দা কথা হ’ল এরা সকলেই মধ্যশ্রেণীভুক্ত। ‘এক ডজন কর্মসূচী’ বা ভুরি ভুরি ‘তাত্ত্বিক’ প্রবন্ধ প্রসব করার ব্যাপারে এরা যতটা উৎসাহ
দেখায়, জীবন্ত অধ্যয়নের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ
কাজ করার ব্যাপারে, ঠিক ততটাই নিরুৎসাহ বোধ করে। সাধারণ
মানুষের সাথে এইসব ‘বুদ্ধিবৃত্তিকর’দের
যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। এরা বচনবাগীশ—কথার ফুলঝুরি
তৈরিতে ওস্তাদ। নিজেদের নিষ্ক্রিয়তাবাদী চরিত্র এরা বাগাড়ম্বর দিয়ে ঢেকে রাখে।
এমনই এক বচনবাগীশের সাথে
একবার কমরেড স্তালিনের দেখা হয়েছিল। তিনি তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন জমিতে বীজ
বোনার কাজে তারা কতটা অগ্রসর হয়েছেন? উত্তরে সেই ‘শ্রদ্ধাভাজন’
কমরেড বলেন, ‘বীজ বোনার কথা জিজ্ঞাসা করছেন
কমরেড স্তালিন? আমরা নিজেদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছি’। এই শুনে স্তালিন প্রশ্ন করেন, ‘বেশ, তার পর?’ সেই কমরেড একইভাবে জানিয়ে দেন, ‘প্রশ্নটাকে আমরা ঠিকঠাক ধরছি’। স্তালিন আবারও জানতে
চান, ‘কিন্তু তার পর?’ উত্তরদাতা ঘোষণা
করেন, ‘মোর ঘুরে যাচ্ছে কমরেড স্তালিন, শীঘ্রই মোর ঘুরবে।’ এতে স্তালিন ফের একই কথা
জিজ্ঞাসা করেন। এবার সেই বাকসর্বস্ব কমরেড একজন বিশেষজ্ঞর মতো ব’লে ওঠেন, ‘কিছুটা এগুতে
পেরেছি। তার লক্ষণ দেখা দিয়েছে বলতে পারি।’ শেষে স্তালিন
বলেন, ‘সবই তো বুঝলাম কিন্তু জমিতে বীজ বোনার ব্যাপারে
আপনারা কি করেছেন?’ কাঁচুমাচু মুখে সেই কমরেড জবাব দেন,
‘কমরেড স্তালিন, বীজ বোনার ব্যাপারে এখনও আমরা
কিছু ক’রে উঠতে পারিনি’।
এই ধরনের একপাল নিষ্ক্রিয়
ইন্টেলেকচুয়াল আমাদের দেশেও আছে। বাম বিকল্পের নাম করে অনেক দিন ধরেই এরা লেনিন-এর
মুণ্ডপাত করার মতলব এঁটে আসছে। সোভিয়েত-এর পতনের ফলে এই ষড়যন্ত্রের মাত্রা বহুগুণ
বেড়ে গেছে। আমাদের রাজ্যে তো কয়েকজন মুরুব্বী গোছের লোক কোমর বেঁধে নেমেই পড়েছে
লেনিন-এর ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র বিরুদ্ধে কলম শানাতে।
এইসব রাঘববোয়ালদের সাথে দু-চার পিস অল্প জলের পুঁটীমাছ-ও জুটেছে। এদের মত হ’ল— সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা পার্টির হাতে
ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়া এবং ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র নীতির ফলেই সোভিয়েত-এর পতন ঘটেছে এবং বাংলায় বাম সরকার পরাজিত হয়েছে।
মুখে অবশ্য এরা ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’ কথাটা উচ্চারণ করার সাহস দেখাচ্ছে না, বলছে ‘রেজিমেন্টেড সংগঠন’, ‘দলতন্ত্র’, ইত্যাদি। এরা এখন ‘গণতান্ত্রিক বাম’-এর ধুয়ো তুলছে, এবং সব চাইতে চিন্তার বিষয় হ’ল, বাজারি মাধ্যমের আগ্রাসী প্রোপ্যাগান্ডার ফলে তা
অনেক সৎ বামপন্থীকে আচ্ছন্ন করছে।
বিধানসভা নির্বাচনে
পরাজয়ের ফলে সাধারণ বাম-সমর্থকদের সাথে সাথে লেনিনবাদী সাংগঠনিক নীতির গুরুত্ব
সম্পর্কে বামপন্থী ক্যাডারদের মনেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাই এই ‘ডেমোক্র্যাটিক
লেফটিজম’ ব্যাপারটা খায় না মাথায় দেয় সেটা পরিষ্কার ভাবে
আমাদের বোঝা দরকার। এই তথাকথিত বামপন্থার দুটো দিক—(১)
পার্টির সাথে জনগণের সম্পর্ক, (২) পার্টিসভ্যদের সাথে পার্টি
নেতৃত্বের সম্পর্ক। আপাতত আমরা বরং প্রথম পয়েন্ট-এর ওপরেই মনঃসংযোগ করি। আগামী
সংখ্যায় নাহয় পরেরটা নিয়ে কথা বলা যাবে।
বর্তমানে ‘গণতান্ত্রিক
বামপন্থা’র সবচেয়ে ‘ভোকাল
রিপ্রেজেন্টেটিভ’ হলেন এমন একজন মহাবিপ্লবী, যিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই ‘কালপুরুষ’
দ্বারা তাড়িত। কখনও তিনি কালী মন্দিরের ঘণ্টা বাজিয়ে শ্যামাসংগীত
গেয়েছেন, কখনওবা বনমালীর থানে অর্ঘ্য দিয়ে ‘শ্রীকৃষ্ণ গোবিন্দ হরে মুরারি...’ বলে নাম জপ
করেছেন। বর্ণময় চরিত্র, সন্দেহ নেই! এহেন বাঘা কলমচির ‘কলাম’ যে ‘বিদ্রোহী’ বাঙালি-কে চিন্তার খোরাক যোগাবে তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে! তা কী বলেছেন
তিনি? তিনি বলেছেন যে, ‘গণতান্ত্রিক
বামপন্থা হ’ল গণতন্ত্র ও বামপন্থার মিলনের (fusion) ফলশ্রুতি।’ তিনি ব্যাখ্যা করেছেন— ‘অনুশীলিত সমাজতন্ত্রের এ তাবৎ অর্জিত অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে’ তিনি ‘এই সত্যে উপনীত’ হয়েছেন ‘যে গণতন্ত্র ছাড়া সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়’। অর্থাৎ ‘জনসাধারণের উদ্যোগ, সক্রিয়তা
ও সৃজনশীলতা মুক্ত না করলে’ সব সমাজবিপ্লবই সোনার পাথরবাটিতে
পর্যবসিত হয়।
কিন্তু এই কথাগুলো বলে
কলমচি পড়েছেন বেজায় ফাঁপরে! যাদের তিনি ‘রেজিমেন্টেড বাম’ বলে
গালি পেড়েছেন, তারাও তো এই একই কথা বলে! ফলে তিনি খানিকটা
ওপরচালাকি করার চেষ্টা করেছেন এই বলে— ‘আসলে রেজিমেন্টেড
বামের চিন্তায় এই প্রশ্নে এক স্ববিরোধ রয়েছে। একদিকে তাঁরা মুখে বলেন যে জনগণই
ইতিহাসের প্রকৃত নির্মাতা, অন্যদিকে একই সঙ্গে তাঁরা ঘোষণা
করেন যে পার্টিই সকল কিছু নির্ধারণ করে। যদি পার্টিই সকল কিছু নির্ধারণ করে,
তবে জনসাধারণের নির্ধারক গুরুত্ব শুধু কথার কথা হয়ে যায়। এর ফলে
জনগণ হতোদ্যম ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।’ নিজের বক্তব্যকে জোরাল
করতে শ্রী সুজিত কুমার দাশের ‘কমিউনিজম ও গণতন্ত্র’ বই থেকে লেখক এই উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন— ‘একটি
পার্টির একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে, অথচ সেই পার্টিতে সমগ্র
জনগণের প্রবেশাধিকার নেই, স্থান নেই—এরম
অবস্থায় গণতন্ত্র সংকুচিত হয় এবং পার্টি ও পার্টি-বহির্ভূত জনগণের মধ্যে
দ্বন্দ্বের মীমাংসার পথ রুদ্ধ হয়।’
বলা বাহুল্য, ‘গণতান্ত্রিক
বামপন্থা’র ধামাধারি এই লেখক বেজায় ধূর্ত। খোলা মনে শুনলে
মনে হবে, ‘বাহ, ভালোই ত বলেছে লোকটা;
সত্যিই তো, গণতন্ত্র ও বামপন্থার মিল না হলে
বামপন্থা ব্যাপারটাই তো কণ্ঠরোধকারী হয়ে দাঁড়ায়’; কিন্তু বাস্তবে
এই লেখাই হ’ল একধরনের প্রতিবিপ্লবী ‘সাবোতাজ’। কেন এই কথা বলছি? আসুন, সেই
উত্তরই খুঁজতে চেষ্টা করি বরং।
লেখক প্রথমেই বলেছেন
বামপন্থার সাথে গণতন্ত্রের ফিউশন প্রয়োজন। এর একটাই মানে দাঁড়ায়—বামপন্থা আর যাই
হোক, গণতান্ত্রিক নয়, ফলে বাইরে থেকে
গণতন্ত্র নামক বস্তুটা এনে এর সাথে মেশালে তবেই বামপন্থা মানব সমাজের পক্ষে উপযোগী
হয়ে উঠবে। অনেকটা এই একই কথা কিছুদিন আগে বললেন জনৈক অধ্যাপক। ইউরোপীয় কম্যুনিস্ট
পার্টিগুলো বা মার্কসবাদে বিশ্বাসী দলগুলো নাকি আজকাল ‘গণতান্ত্রিক
বাম’-এর কথা বলছে এবং সেই সাথে জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করছে
যে আদর্শ মানবতাবাদী সমাজ গড়তে হলে মার্কসবাদকে কোনওমতেই বাদ দিলে চলবে না। একথা
শুনে স্বাভাবিক ভাবেই অনেকে খুশি হয়েছেন, কিন্তু তারা লক্ষ্য
করেননি যে অধ্যাপক মশাই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে গেছেন। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে
মানুষ কোনও সমসত্ত জীব নয়। তাই ওসব মানবতা-ফানবতা কথাগুলো নেহাতই ফাঁকা বুলি। তিনি
চেপে গেছেন যে, শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে ও শ্রমিক-কৃষক
মৈত্রীর ভিত্তিতেই প্রকৃত জনমুখি সমাজ তৈরি হতে পারে, এবং তা
সম্ভব একমাত্র মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পথে। অর্থাৎ,
মানবতাবাদী ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের জন্যে মার্কসবাদ মোটেও কোনও বিশেষ উপাদান নয়,
জনমুখিনতা ও গণতন্ত্র হ’ল মার্কসীয়
বিশ্ববিক্ষার দুটো উল্লেখযোগ্য অংশ।
এসব শুনে কেও কেও হয়তো
বলবেন—‘আহা, ওগুলো তো কথার কথা...’।
আমরা বলব— নাহ, মোটেই তা নয়। ওইখানেই
লুকিয়ে আছে এই ইন্টেলেকচুয়ালদের আসল বজ্জাতি।
যাইহোক, মূল প্রসঙ্গে আসা
যাক। তবে শুরু করার আগে এই প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া দরকার জনগণ বলতে আমরা কাদের
বুঝবো? গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে জনগণের সংজ্ঞা নির্ভর করে
নির্দিষ্ট দেশের নির্দিষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। আজ যদি আমাদের দেশ
কোনও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে প্রত্যক্ষভাবে আক্রান্ত হয় তাহলে যে সমস্ত শ্রেণী,
স্তর ও সামাজিক গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে তারাই জনগণ হিসাবে
বিবেচিত হবে। উলটো দিকে সাম্রাজ্যবাদকে যে সমস্ত শ্রেণী বা স্তর বা গোষ্ঠী সমর্থন
করবে তারা বিবেচিত হবে জনগণের শত্রু হিসাবে। ফলস্বরূপ সাম্রাজ্যবাদের সাথে জনগণের
দ্বন্দ্বই প্রধান দ্বন্দ্ব বা ‘প্রিন্সিপাল কন্ট্রাডিকশন’
হিসাবে উঠে আসবে। বর্তমান পর্যায়ে আমরা জনগণ বলতে তাদেরই বুঝি যারা
সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের বিরোধিতা করে, বিরোধিতা করে
আমলাতান্ত্রিক মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদের এবং এদের বিরুদ্ধে কম্যুনিস্ট ও বামপন্থীদের
নিরলস লড়াইকে সমর্থন করে ও পাশে থাকে। অনেকেই আছেন যারা এই তিন স্তম্ভের বিরুদ্ধে
লড়াই করতে চান কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব মানতে চান না, বিপ্লবের স্বার্থে আমাদের তাদের সাথেও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং তাদের জিতে
নিতে হবে সংগ্রামের ময়দানে। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ এবং
আমলাতান্ত্রিক মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী শ্রেণী ও গোষ্ঠীগুলো হ’ল— (১) শ্রমিক শ্রেণী, (২)
কৃষক সম্প্রদায় (৩) শহুরে পাতি বুর্জোয়া (৪) জাতীয় বুর্জোয়া।
এবার দেখা যাক এই চার
জনগণের সঙ্গে পার্টির সম্পর্কের ব্যাপারটা।
শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রণী
অংশের শ্রেণী সংগঠনের নাম কম্যুনিস্ট পার্টি। কম্যুনিস্টরা হ’ল শ্রমিকশ্রেণীর
সর্বাপেক্ষা অগ্রসর ও দৃঢ়চিত্ত অংশ। শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের এগিয়ে যাওয়ার পথ,
শর্ত এবং শেষ সাধারণ ফলাফল সম্বন্ধে সঠিক ধারণা থাকে একমাত্র
কম্যুনিস্টদেরই। এই মুহূর্তে আমাদের দেশে কম্যুনিস্ট পার্টিগুলোর লক্ষ্য হ’ল নিরলস সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা এবং
জনগণতান্ত্রিক একনায়কত্ব কায়েম ক’রে সমাজতান্ত্রিক সমাজ
গঠনের কাজে এগিয়ে যাওয়া। এই কাজ সুষ্ঠু ভাবে করতে হলে উপরোক্ত জনগণকে সঙ্গে নিয়ে
গড়ে তুলতে হবে প্রকৃত জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট।
এটা সবাই জানেন, গোটা দুনিয়া
জুরেই কম্যুনিস্ট পার্টিগুলোর ভেতরে শুধু শ্রমিক নন, অন্যান্য
শ্রেণী থেকে আসা মানুষজনও থাকেন। বিপ্লবপূর্ব চিনের মতো ভারতবর্ষেও কম্যুনিস্ট
পার্টির ভেতরে পাতি বুর্জোয়ার সংখ্যা বিপুল। এরা যেমন একদিকে শ্রমিকশ্রেণীকে শ্রেণী-সচেতন
ক’রে তুলতে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে, আবার অন্যদিকে কখনও কখনও উদারতাবাদী ঝোঁক দেখিয়ে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদী
লাইন গ্রহণ করে, অথবা জনগণের ভূমিকা-কে উপেক্ষা ক’রে বামপন্থী সংকীর্ণতা ও হঠকারিতা ক’রে বসে। শেষের
দুটো প্রবণতা অতিক্রম করা সম্ভব যদি জনগণের থেকে কম্যুনিস্টরা শিক্ষাগ্রহণ করতে
পিছ-পা না হয়। আমাদের স্মরণে রাখা দরকার যে, ‘কেবল মাত্র
জনগণই হলেন বিশ্ব-ইতিহাস সৃষ্টির চালিকাশক্তি’। ‘তারাই হচ্ছেন প্রকৃত বীর এবং আমরা হলাম শিশুর মতো অজ্ঞ এবং উপহাস্য’। তাই মানুষের সঙ্গে জীবন্ত যোগাযোগ রাখা ও তাদের দৈনন্দিন সংগ্রামে যুক্ত
হওয়া একজন কম্যুনিস্টের অবশ্য কর্তব্য। বিপ্লব সফল করতে জনগণের সাথে যোগ স্থাপন
করা ছাড়া আর কোনও পথ নেই। মাও সঠিক ভাবেই বলেছেন— ‘আমরা
কম্যুনিস্টরা হচ্ছি বীজের মতো, জনগণ হচ্ছেন জমির মতো। আমরা
যেখানেই যাই না কেন, সেখানকার জনগণের সংগে সংযুক্ত হতে হবে,
জনগণের মধ্যে শিকড় গাড়তে এবং প্রস্ফুটিত হতে হবে’।
অনেকসময় দেখা যায়
কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ার সুবাদে কেও কেও শুধু সাংগঠনিক প্রভাব খাটিয়ে
জনগণের নেতা হয়ে বসে। এটা মোটেই ঠিক নয়। এটা একধরনের আমলাতান্ত্রিক মানসিকতার
পরিচয়। ফলে একে সমূলে উৎপাটিত করতে দ্বিধাবোধ করে না কম্যুনিস্ট পার্টি। জনতার
নেতা হতে হলে সবার আগে সেই পার্টি-সদস্যকে যোগ্য হয়ে উঠতে হবে, তাদের (জনতাকে)
বুঝতে হবে, সমস্ত ভুল চিন্তাকে পরাজিত করতে হবে, জনতার স্বার্থকে নিজের স্বার্থের ওপরে রাখতে হবে, জনগণের
থেকে শেখার মানসিকতা রাখতে হবে, অর্থাৎ তাকে হতে হবে
প্রসারিত হৃদয়; তাকে মনে রাখতে হবে যে কম্যুনিস্ট পার্টি হ’ল এমনই এক সংগঠন যা জনগণের থেকেই শেখে এবং সেই শিক্ষার নিরিখে জনগণকেই তার
(পার্টির) নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করে। তাকে মনে রাখতে হবে মাও-এর সুস্পষ্ট নির্দেশ—
জনগণের শিক্ষক হতে গেলে প্রথমে তাদের ছাত্র হতে হবে এবং অবশ্যই
গাদটা ফেলে দিয়ে শাঁসটা গ্রহণ করতে হবে।
আগেও বলেছি, কম্যুনিস্ট
পার্টি শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রবাহিনী, বিপ্লব সংগঠনে নেতৃত্বকারী
অংশ। অতএব এখানে সমগ্র জনগণের এবং শ্রমিকশ্রেণী ও কৃষক সমাজের পশ্চাৎপদ অংশের অবাধ
প্রবেশাধিকার থাকবে — এমনটা ভাবার কোনও যৌক্তিকতা নেই। আবার
একই সাথে মনে রাখা দরকার, ‘একমাত্র অগ্রণী অংশকে নিয়েই জয়ী
হওয়া সম্ভব নয়। সমগ্র শ্রেণী, ব্যাপকতর জনগণ যতক্ষণ না
অগ্রণী অংশকে সমর্থন বা তাদের প্রতি মৈত্রী-ভাব রেখে নিরপেক্ষতার মনোভাব গ্রহণ
করছে, অন্তত: শত্রুপক্ষকে কোনওমতেই সাহায্য বা সমর্থন করতে
এগুচ্ছে না—এরকম অবস্থার আগে অগ্রণী অংশকে চূড়ান্ত সংগ্রামে
ঠেলে দেওয়াটা শুধু মূর্খতা নয়, অপরাধ। আর সমগ্র শ্রেণী, শ্রমজীবী জনতা ও পুঁজির দ্বারা নিপীড়িত জনতা বাস্তবিকপক্ষে যাতে এরকম
একটা অবস্থায় পৌঁছাতে পারে তার জন্য শুধু মতবাদ ও দৈনন্দিন আন্দোলনের প্রচারই
যথেষ্ট নয়। এর জন্য চাই নিজস্ব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা।’ নিজেদের
এবং জনগণের বৃহদাংশকে কী ভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় শিক্ষিত ক’রে তোলা যায়? একটাই পথ—তাদের
দৈনন্দিন সংগ্রামের সাথে ওতপ্রোত ভাবে সংযুক্ত হয়ে, তাদের
সাথে সম্পৃক্ত হয়ে। বিপ্লবী শ্রেণীর মধ্যেও অগ্রণী আর পশ্চাৎপদ—এই দুই ভাগ থাকে। দ্বিতীয় অংশকে মোটেই অবজ্ঞা করা উচিৎ নয়। তাদের সাথে
আলোচনা চালানো উচিৎ, সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্যে তাদের
প্রেরণা দেওয়া উচিৎ।
জনগণের প্রতিদিনের
সংগ্রামের সাথে যুক্ত হওয়ার উপায় কী? উপায় হ’ল পার্টির
গণসংগঠন মারফৎ গণআন্দোলন পরিচালনা করা। এই আন্দোলনের চরিত্র সাধারণত হবে অর্থনৈতিক,
যদিও খেয়াল রাখতে হবে যাতে এর সাথে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটাও সফল হয়।
গণসংগঠনগুলোই পার্টির সাথে সাধারণ জনতা ও শ্রেণীর পশ্চাৎপদ অংশের যোগাযোগের পথকে
মসৃণ করে। গণসংগঠনগুলো হ’ল পার্টি ও জনগণের মধ্যে
সংযোগ-রক্ষাকারী মাধ্যম বা ‘ট্রান্সমিশন বেল্ট’। এর মাধ্যমেই পার্টির সাথে সাধারণ জনতার সখ্যতা গড়ে ওঠে। গণসংগঠনগুলো
যেহেতু পার্টির অনুমোদনপ্রাপ্ত হওয়া স্বত্বেও অনেক বেশী সাংগঠনিক স্বাধীনতা উপভোগ
করে এবং নেতৃত্বকারী পদে পার্টি-বহির্ভূত মানুষদেরও তুলে আনে, সেহেতু একইসাথে দুটো কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হয়— (১)
পার্টি-বহির্ভূত মানুষদের সঙ্গে প্রাণবন্ত যোগাযোগ (২) পার্টির শ্রেণী-চরিত্র
রক্ষা। এগুলো ঠিক ভাবে কাজ করলে তবেই জনগণের উদ্যোগের দ্বার খুলে যায় এবং তারা
পার্টির মতকে সার্বিক ভাবে প্রভাবিত করতে সমর্থ হয়। গণসংগঠনের ওপরে চূড়ান্ত
পার্টি-কর্তৃত্ব চাপালে আমলাতান্ত্রিক প্রবণতার জন্ম হয় এবং ক্রমশ তা গোটা
রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই গ্রাস করে (সোভিয়েত ইউনিয়ন-এও পরবর্তীকালে এইটাই ঘটেছিল)।
একইভাবে সমগ্র জনগণ যদি পার্টিতে প্রবেশাধিকার পায় (যেমনটা ‘গণতান্ত্রিক
বাম’ তত্ত্বের প্রচারকরা বলছেন) তাহলে শ্রমিকশ্রেণীর
সর্বোচ্চ শ্রেণী সংগঠন গণ-অর্থনৈতিক সংগঠনের পর্যায়ে অধঃপতিত হয় এবং স্বাভাবিক
ভাবেই বিপ্লবী সংগ্রামের সম্ভাবনা চিরতরে শেষ হয়ে যায়।
বিপ্লব-পরবর্তী সমাজের
গণতান্ত্রিক সংগঠনের নাম ‘সোভিয়েত’। এগুলো বিপুল বিপ্লবী জনতার নিজস্ব সংগঠন। ‘সোভিয়েত’ হ’ল রাষ্ট্র-ক্ষমতার
একক, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রধান উপাদান। ভিশিনস্কির মতে,
‘The Soviets are organs of state authority which ensure a constant, essential
and decisive participation of the people in the democratic management of the
state.’ এগুলো যে কথার কথা নয় তা জন রিড-এর ‘দুনিয়া
কাঁপানো দশ দিন’ বইটা পরলেই বোঝা যায়। মার্কিন সাংবাদিক জন
রিড তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় আবিষ্কার করেছিলেন— জনমতের
প্রতি এর (সোভিয়েত) থেকে বেশী প্রয়োজনীয় এবং সংবেদনশীল ও দায়দায়িত্বশীল কোনও
রাজনৈতিক সংস্থা আর আবিষ্কৃত হয়নি।
অনেকেই মনে করেন বিপ্লবের
পরে কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের প্রয়োগ ঠিক নয়।
জার্মান নেত্রী রোজা লুক্সেমবার্গ তো ঘোষণাই করেছিলেন—‘একনায়কত্বটা একটা
শ্রেণীর দ্বারা প্রযুক্ত হবে, তার তরফে প্রতিনিধিত্বকারী
কোনও একটা সংখ্যালঘু অংশের নেতৃত্বে নয়।’ অনেকের মতোই রোজাও
ভাবতেন, এর ফলে মার্কসীয় ধারণার বিকৃতি ঘটবে এবং গণতন্ত্রের
কণ্ঠ রুদ্ধ হবে। তাই তিনি আরও বলেছিলেন—‘শুধু মাত্র সরকারের
সমর্থক বা পার্টির সদস্যদের জন্য স্বাধীনতা মানে কোনও স্বাধীনতাই নয়। স্বাধীনতার
আসল মানে হ’ল ভিন্নমতাবলম্বীর বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতা।’
বলা বাহুল্য, যেকোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ
এইভাবেই চিন্তা করছেন। কিন্তু তা যদি সংগ্রামী দেশের পরিপ্রেক্ষিত বিচার না করে
চিন্তা করা হয়, তাহলে সংগ্রামের অর্জিত ফসলগুলোকে রক্ষা করা
যাবে না এবং সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রস্তাবই কল্পনাবিলাসে অধঃপতিত হবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কথাই
ধরুন। সেখানে বিপ্লব সফল হওয়ার পর শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব চালানোর জন্য পার্টির
ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় কি? গৃহযুদ্ধের পরিবেশে এছাড়া কোনও উপায় ছিল কি? সাধারণ ভাবে কি থাকা সম্ভব, বিশেষ ক’রে যখন চারিদিকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো নখ-দাঁত বার করে বসে আছে শিশু
রাষ্ট্রের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য? তবে রোজা যেমন ভেবেছিলেন,
শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব পার্টির নেতৃত্বে প্রযুক্ত হলে তা পরিশেষে
পার্টির একনায়কত্বে পর্যবসিত হবে, এটা ঠিক ছিল না। হ্যাঁ,
অনেকেই এ’দুটোকে মিশিয়ে দেওয়ার ফন্দী করেছিলেন,
কিন্তু সফল হতে পারেননি। যেমন জিনোভিয়েব। তিনি সিদ্ধান্তে
পৌঁছেছিলেন যে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব আর পার্টির একনায়কত্ব সমার্থক, কারণ এই ব্যবস্থায় পার্টিই হ’ল প্রধান চালিকাশক্তি।
স্তালিন এর তীব্র প্রতিবাদ করেন, জিনোভিয়েব-কে তিরস্কার করে
বলেন—‘এর অর্থ হ’ল শ্রেণী ও পার্টির
মধ্যে, সমগ্র ও সমগ্রের একটি অংশের মধ্যে সমতার চিহ্ন বসানো,
যা অসম্ভব ও ভ্রান্ত। পার্টি ও শ্রেণীকে লেনিন কখনও এক করেননি এবং
কখনও এক করতে পারতেন না। পার্টি ও শ্রেণীর মাঝখানে রয়েছে সর্বহারাদের
পার্টি-বহির্ভূত গণসংগঠনগুলো এবং তাদেরও পেছনে রয়েছে শ্রমিক শ্রেণীর সমগ্র জনগণ।
পার্টি-বহির্ভূত এই গণসংগঠনগুলো ও সমগ্র সর্বহারা জনগণের স্থান পার্টি গ্রহণ করতে
পারে এটা ধারণা করার অর্থ হ’ল পার্টিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন
করা, পার্টির আমলাতান্ত্রিকরণ চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া,
পার্টিকে একটা অভ্রান্ত শক্তিতে রূপান্তরিত করা ও পার্টিতে “নেচায়েভবাদ” (ষড়যন্ত্রমূলক,
সন্ত্রাসবাদী কৌশল যা সদস্যদের নিজস্ব মতামত প্রকাশে বাঁধা দেয়) এবং “আরাকচেয়েভবাদ” (জনগণের ওপর নিপীড়নকারী ব্যবস্থা) প্রবিষ্ট করানো।’
পার্টি (শ্রমিকশ্রেণীর
অগ্রণী অংশ ও সর্বহারার একনায়কত্ব কায়েমের অধিনায়ক), ট্রেড ইউনিয়ন (শ্রেণীর অগ্রবাহিনীর
সাথে শ্রেণীর সম্পর্ক স্থাপনের সংযোগকারী ব্যবস্থা), সোভিয়েত
(লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী জনতাকে সর্বহারার প্রধান কেন্দ্রের সাথে সংযুক্ত করার সংগঠন
এবং সর্বহারার একনায়কত্বের প্রত্যক্ষ প্রকাশ), সমবায় (কৃষক
সম্প্রদায়ের সাথে পার্টির সম্পর্ক-রক্ষাকারী সংগঠন এবং তাদের সমাজতান্ত্রিক উৎপাদনে
টেনে আনার উপায়) এবং যুবলীগ ও অন্যান্য গণসংগঠনগুলো মিলেই তৈরি হয় সর্বহারার
একনায়কত্ব।
বিরোধী কণ্ঠস্বর যাতে
উচ্চমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়, তারও ঐকান্তিক চেষ্টা চালায় কম্যুনিস্টরা। এর জন্য
তাদের কোনও তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক বামপন্থা’র দরকার পরে না। অনেকে ভুলেই যান যে প্রথম দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন-এ বিরোধী
দল এবং গোষ্ঠীগুলো পূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করতো। কিন্তু লেনিনবাদ শিক্ষা দেয় শ্রমিক
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে শ্রেণী-সংগ্রাম শুধু বজায়-ই থাকে না, আরও বেড়ে যায়। কবরে এক-পা ঢুকিয়েও নিপীড়নকারী শ্রেণীগুলো সমাজে বিষপ্রয়োগ
করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। ‘ষড়যন্ত্র করো, ব্যর্থ হও, আবার ষড়যন্ত্র করো এবং ব্যর্থ হও যতক্ষণ
না কবরে যাও’—এটাই ওদের বৈশিষ্ট্য। এই ইঙ্গিতই পাওয়া যায় রুশ
শ্রেণী-শত্রুদের কাজকর্মে। কম্যুনিস্ট পার্টির নমনীয়তাকে তারা মনে করে দুর্বলতা।
তাই ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে। তৎকালীন পরিস্থিতি বোঝার জন্য এমিল লুডভিগ-কে দেওয়া
স্তালিন-এর সাক্ষাৎকার থেকে একটা বিশেষ অংশ উদ্ধৃত করা যাক— ‘বলশেভিকরা যখন ক্ষমতায় এলো, তখন শুরুর দিকে শত্রুদের
সাথে নরম ব্যবহার করেছিল। আইনসঙ্গতভাবেই মেনশেভিকরা তাদের কাজকর্ম চালাতে পারল,
এবং তাদের সংবাদপত্র প্রকাশ করতে থাকল। সোশালিস্ট রেভোলুশানারিরা
আইনসঙ্গতভাবে রয়ে গেল, এবং তাদের সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে
থাকল। জেনারেল ক্রাসনভ যখন লেনিনগ্রাদের বিরুদ্ধে তার প্রতিবিপ্লবী অভিযান সংগঠিত
করলেন ও আমাদের হাতে ধরা পড়লেন তখন আমরা যুদ্ধের আইন অনুযায়ী তাকে অন্তত: কয়েদ
করতে পারতাম। সন্দেহ নেই, আমাদের উচিৎ ছিল তাকে গুলি করে
মারা। তিনি আত্মসম্মানের দোহাই পেড়ে প্রতিশ্রুতি দিলেন। আর আমরা গুলি করে মারার
বদলে তাকে ছেড়ে দিলাম। ফলটা কি হ’ল? অচিরেই
পরিষ্কার হয়ে গেল যে ওরকম নরম মনোভাব সোভিয়েত শাসনের শক্তিকে হেয় করতেই সাহায্য
করছে। শ্রমিকশ্রেণীর শত্রুদের বিরুদ্ধে ওরকম নরম মনোভাব দেখিয়ে আমরা ভুল করেছিলাম।
ঐ ভুল আঁকরে থাকলে শ্রমিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে অপরাধ করা হতো, তার
স্বার্থের প্রতি করা হতো বিশ্বাসঘাতকতা। এটা খুব তাড়াতাড়ি স্পষ্ট হয়ে গেল। খুব
শীঘ্রই এটা পরিষ্কার হ’ল, শত্রুর প্রতি
আমাদের মনোভাব যত বেশী নরম হবে, ততোই তাদের প্রতিরোধ জোরদার
হয়ে উঠবে। কিছু দিনের মধ্যেই দক্ষিণপন্থী রেভোলুশানারিরা—গোৎজ
ও অন্যান্যরা—এবং দক্ষিণপন্থী মেনশেভিকরা লেনিনগ্রাদে সামরিক
ক্যাডেটদের এক প্রতিবিপ্লবী আক্রমণ সংগঠিত করেছিল, যার ফলে
আমাদের অনেক বিপ্লবী নাবিক নিহত হয়েছিলেন। এই ক্রাসনভ, যাকে
আমরা তার আত্মসম্মানের দিব্যি’তে ছেড়ে দিয়েছিলাম—তিনিই শ্বেতরক্ষী কসাকদের সংগঠিত করেছিলেন। তিনি মাসোস্তভের বাহিনীর সাথে
নিজের বাহিনী জুড়ে দিলেন এবং ২বছর ধরে সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই
সংগঠিত করলেন। খুব শীঘ্রই প্রমাণিত হ’ল— শ্বেতরক্ষী জেনারেলদের পেছনে পশ্চিমী পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ফ্রান্স, ব্রিটন, আমেরিকা—এমনকি জাপানের
দালালরাও হাজির। আমরা নিশ্চিত হলাম। নরম মনোভাব দেখিয়ে আমরা ভুল করেছি। অভিজ্ঞতার
সাহায্যে শিখলাম, এরকম শত্রুর মোকাবিলা করার একমাত্র রাস্তা
হ’ল তাদের প্রতি নির্মমতম দমননীতি গ্রহণ করা।’
রোজাপন্থী (এদের সাথে
রোজা লুক্সেমবার্গ-এর কোনও সম্পর্ক নেই) ও অন্যান্য ‘গণতান্ত্রিক
বামপন্থী’রা কি বলবেন? প্রতিক্রিয়ার
অভ্যুত্থান দেখে কম্যুনিস্টদের হাতে হাত ধরে চুপচাপ বসে থাকা উচিৎ? যদি তাই বলেন তাহলে দয়া করে আপনারা মার্কসবাদ ছেড়ে অন্য কোনও তত্ত্ব
খুঁজে নিন, অথবা নিজেরাই কিছু একটা বানিয়ে নিয়ে শাঁখ-ঘণ্টা
বাজাতে থাকুন! আবারও বলছি— মানুষ কোনও সমসত্ত জীব নয়। উৎপাদনের
উপকরণের যারা মালিক তারা কোনোমতেই সেই মালিকানা ছাড়তে চায় না। তারা উৎপাদককে
ছলে-বলে-কৌশলে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে এবং নিজেরা স্ফীত হয়ে ওঠে। যখন তারা
দেখে মেহনতি মানুষ জেগে উঠেছে, তখন মাত্রাহীন হিংসা প্রয়োগ
করে তাদের দাবিয়ে রাখতে চায়। এই নরপিশাচদের সাথে কীসের গণতান্ত্রিক বোঝাপড়া?
এদের ওপর বলপ্রয়োগের নীতিটাই সঠিক। এঙ্গেলস বলেছেন— ‘কর্তৃত্বমূলক যত যা আছে তার মধ্যে নিশ্চয়ই সবচেয়ে কর্তৃত্বপ্রধান হ’ল বিপ্লব। বিপ্লব হ’ল এমন এক কাজ যাতে জনসংখ্যার এক
অংশ যতরকমের কর্তৃত্বাশ্রয়ী উপায় আছে, সেই বন্দুক, বেয়নেট, কামানের মাধ্যমে জনসংখ্যার অপর অংশের ওপর
নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়। আর বিজয়ী দল যদি নিজেদের সংগ্রাম ব্যর্থ হতে দিতে না চায়,
তাহলে তাদের নিজেদের শাসন বজায় রাখতে হবে অস্ত্রের সাহায্যে
প্রতিক্রিয়াশীলদের মনে ভীতির সঞ্চার করেই।’
ফলে, যারা কম্যুনিস্ট
পার্টির তথাকথিত একদলীয় শাসনে গণতন্ত্রের অভাব নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, তারা হয় চূড়ান্ত নির্বোধ, নয়তো আদ্যন্তে
বিশ্বাসঘাতক। হ্যাঁ, এই শাসন প্রক্রিয়াও বিভিন্ন কারণে
আমলাতান্ত্রিকতার জালে আটকে পড়তে পারে (সোভিয়েতও পরবর্তীকালে আমরা এই সমস্যা
দেখেছি)। কিন্তু সেটা হয় মার্কসবাদের মৌলিক নীতিগুলোকে বিসর্জন দিলে। আর
আমলাতন্ত্রের সমস্যা, মানুষের কণ্ঠরোধ করার সমস্যা তো আমরা
বহুদলীয় বুর্জোয়া গণতন্ত্রেও দেখেছি। হিটলার থেকে ইন্দিরা গান্ধী, বুর্জোয়া গণতন্ত্রেরই ফসল। তাহলে? ‘গণতান্ত্রিক
বামপন্থা’র ধ্বজাধারীরা কি এদের দেখতে পান না? বাংলায় কি হ’ল? বহুদলীয়
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই তো ওস্তাদের খেল দেখিয়ে দিল আমেরিকা! আর একটা জিনিশ
মাথায় রাখা উচিত— লেনিন বলেছিলেন কম্যুনিস্টরা সৃষ্টি করতে
চায় এমন এক পার্লামেন্ট যা হবে অভিনব, সুবিধাবাদ বর্জিত,
পদলালসাবর্জিত। অত্যাচারী শ্রেণীগুলো যদি সমাজে উৎপাদক শ্রেণীগুলোর
মতোই মর্যাদা পায়, সামাজিক সুবিধা ও নিরাপত্তা পায়, তাহলে কি এই নতুন পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা চালু করা যাবে? আমাদের এত দিনের অভিজ্ঞতা কি বলে? পপুলিস্ট কথা বলে
বাজার গরম করা যায়, কাজের কাজ হয় না। সরোজ দত্ত বলতেন
ইন্টেলেকচুয়ালী কুসংসর্গ থেকে কম্যুনিস্ট-দের মুক্ত হওয়ার সময় এসেছে। এই কথাটা যেন
আমরা কখনও ভুলে না যাই।
Awsadharon lekha....Asim Chatterjee'r lekha gulo pore amaro mone hoyechhilo....regimentation baad diley se party ar communist party thake kina....lekhoker byakhya pore byaparta poriskar holo....
ReplyDeleteমাকুকুত্তাদের বিপ্লব এখন নেট দুনিয়াতে
ReplyDeleteসত্যিই অসাধারণ রচনা! আমি আমার পাঠকদের পড়ানোর জন্য এটা ধার নিচ্ছি।
ReplyDelete