ভোরের বৃষ্টিকে তুচ্ছ ক’রে দিল্লীর
লালকেল্লার সামনে জমা হয়েছিল অসংখ্য মানুষ। উদ্দেশ্য :
ভারতবর্ষের ৬৪তম স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে সামিল হওয়া। এমনকি স্কুলের ছাত্ররাও
বৃষ্টির তোয়াক্কা না ক’রে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে এসেছিল।
জনতার মন এবং দেশের ‘মান’ রাখতে সাদা
বর্ষাতি জড়িয়ে কংগ্রেসি রাজনীতিবিদরাও উপস্থিত ছিলেন। কিছুক্ষণ পরে নির্ধারিত সময়ে
কাক-ভেজা অবস্থায় হাজীর হলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাশয়। সদ্য রাজঘাট-এ ফুল চরিয়ে
‘পবিত্র’ হয়ে এসেছেন। বৃষ্টিতে ভিজে
জ্বর-জারি হতে পারে, সেই ভেবে প্যারেডের আয়তন ছোট করে দেওয়া
হ’ল। ‘গার্ড অব অনার’ নিয়ে আমাদের মহান দেশ-পালক উঠে এলেন বুলেটপ্রুফ রস্ট্রামে। শুরু হ’ল জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ, যার আধখানা জুড়ে শুধু ‘দুর্নীতি’ আর ‘দুর্নীতি’। আবারও পরিষ্কার হ’ল— ‘কোরাপশন’-এর কাদায় বেশ ভালই ফেঁসেছে বড়-বৌমা ও তাঁর
সর্দার কেয়ারটেকারের UPA-2 সরকার।
মনমোহন সিং-এর ভাষণে একটা
প্রচ্ছন্ন হুমকি কালকেই লক্ষ্য করা গেছিলো। কিন্তু সেটা যে পরের দিনই প্রকট হয়ে
বড়-গিন্নী ইন্দিরার কথা মনে করিয়ে দেবে, একেবারে আধা-ফ্যাসিস্ট দাঁত-নখ বার করে
তেরে আসবে, এটা আমরা অনেকেই ভাবতে পারিনি। কিন্তু যা ভাবতে
পারিনা তাও তো হয়, না হ’লে অভিধানে ‘অভাবনীয়’ শব্দটা এলো কোথা থেকে!
গোটা দেশের তামাম জনতাকে
স্তম্ভিত করে দিয়ে আজ সকালে অনশন আন্দোলন শুরু করার ঠিক আগেই ‘জয় প্রকাশ নারায়ণ
পার্ক’-এর মুখ থেকে গ্রেপ্তার করা হ’ল
ভারতের পৌর-আন্দোলনের প্রধান, গান্ধীবাদী নেতা আন্না
হাজারেকে। সাথে সাথে পুলিশ হেপাজতে নেওয়া হ’ল তাঁর আরও
কয়েকজন সহযোগীকে। তারপর থেকেই দফায় দফায় আন্দোলন, পিকেটিং,
রাস্তা-রোকো, ইত্যাদি চলছে গোটা দেশ জুড়ে।
কালো টাকা ফিরিয়ে এনে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে, লোকপাল নামক ‘আলবালছাল’ (শব্দ-সৌজন্যঃ নচিকেতা চক্রবর্তী) বাতিল ক’রে জন-লোকপাল গ্রহণ করতে হবে... আন্দোলনের কত না দাবী! দেশের রাজনৈতিক
মহলও এই নিয়ে কোমর বেঁধেছে। বামে-দক্ষিণে একাকার...
কিন্তু এই ডামাডোলের
মধ্যে কেউই আসল জিনিসটা লক্ষ্য করছেন না বা হয়তো লক্ষ্য করেও চুপ ক’রে আছেন।
পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের ৬৪ বছরের ‘স্বাধীনতার’
ইতিহাসে দুর্নীতির বিষয়টাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়— নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতি চালু হওয়ার আগে ও পরে। আগের ৪৪ বছরে দুর্নীতির
মাত্রা ছিল ৩৪ শতাংশ। কিন্তু পরের ২০ বছরে প্রায় দ্বিগুণ, ৬৬
শতাংশ! তার মানে কি আগের দেশপালরা চুরি-জোচ্চুরি কম করতেন? না,
তা নয়। আমলাতন্ত্রের জালে জড়িয়ে থাকা সংসদীয় রাজনীতির অন্যতম দিকই হ’ল, কবির সুমন যেমনটা বলেছেন, ‘খাও
খাও খাও...’। গোটা ব্যাপারটা থেকে একটা স্পষ্ট ছবি বেড়িয়ে
আসছে – নয়া-উদারনীতি দুর্নীতির আঁতুড়ঘর।
সিভিল সোসাইটির স্বঘোষিত
মুখপাত্র আন্না হাজারে বা তাঁর সহযোগীরা এই বিষয়ে চুপ করে আছেন, সরকারী
বামপন্থীরাও এই ইস্যু দুটোকে মিলিয়ে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনীহা
দেখাচ্ছেন। আর দক্ষিণপন্থীদের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
এ এক আশ্চর্য অবস্থার
মুখোমুখি আমরা। মূল প্রশ্নকে আড়াল করে আন্দোলন চলছে, এদিকে দিনের পর দিন দারিদ্র,
অস্বাস্থ্য, ক্ষুধা ও বিভিন্ন হিংসাত্মক
প্রক্রিয়ায় ধ্বংস হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আন্না কি ভুলে গেছেন গান্ধীর এই উক্তি—
‘poverty is the worst from of violence’? কবে বন্ধ হবে এসব?
নাঃ! সত্যি জানি না আমরা। তবে বন্ধ করতে গেলে যেটা দরকার, সেটা একটা আমূল পরিবর্তন, গুণগত উল্লম্ফন।
যাইহোক, লড়াইয়ের সময় যখন
তৈরি হয়, তখন কেও না কেও তার ঝাণ্ডা তুলে নেয়। এবারও ঝাণ্ডা
তুলে নিয়েছেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, ঝাণ্ডা তুলে নিয়েছেন
বাস্তারের সেই ১৬ বছরের ছেলেটা যার দিদিকে তার চোখের সামনে ধর্ষণ ক’রে খুন করে গেছিল ‘স্বাধীন’ ভারতের
সামরিক বাহিনীর বীরপুঙ্গবরা। তাঁরা এক বুক ঘৃণা নিয়ে তরঙ্গমালার মতো এগিয়ে আসছেন
স্বজন হারানো শ্মশানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার জল্লাদ সেবাদাসদের চিতা জ্বালতে।
পুরাতনের গর্ভে নতুন সমাজের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আসুন, আমরাও
ধাত্রীর ভূমিকা পালন করি।
পুনঃ - কথায় বলে,
বৃহৎ শত্রুকে হারাতে মাঝে মাঝে ছোট শত্রুর সাথে সাময়িক যৌথ মোর্চা
তৈরি করা যেতে পারে। আন্না হাজারের আন্দোলনের প্রতি তাই সমর্থন রইলো। যদিও জানি
শুধু এই দিয়ে কোনও বিশেষ লাভ হবে না, আগেও হয়নি।
No comments:
Post a Comment