মুখবন্ধ
চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর আজ চার দশকেরও বেশী
সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে
সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন। নয়া-উদারনীতির পোশাকে, বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী গতিপথে নয়া-ঔপনিবেশিক
লুণ্ঠন বেরে গিয়েছে শতগুণ। চিনের অতিপুঁজিবাদী অভিযান ও এক সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী
শক্তি রূপে অধঃপতন এবং সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত তথাকথিত সোশ্যালিস্ট ব্লকের ধ্বস-ভাঙন
বিশ্বব্যাপী সাধারণ মার্কসবাদীদের ভেতর সৃষ্টি করেছে তুমুল বিভ্রম।
দুনিয়াজোড়া এই প্রবণতার সাযুজ্যেই পাঁকে আটকে আছে
ভারতের বাম আন্দোলন। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন ভারতীয় বামপন্থীরা গুরুত্ব হারাচ্ছেন, নিজেদের
অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বেছে নিচ্ছেন সাম্রাজ্যবাদী দাওয়াই—‘দেয়ার ইজ নো অল্টারনেটিভ’—‘টিনা’। মুখে
উদারনীতির বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁদের হাতেই রূপ নিচ্ছে ‘সেজ’, পারমাণবিক
আবর্জনাগার, ঘটছে সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম। কেউ কেউ আবার সংসদীয় হাতছানিতে সাড়া
দিয়ে ‘আধা-ঔপনিবেশিক’ রাষ্ট্র-চরিত্রকে সুবিধা মত পালটে ক’রে নিচ্ছেন ‘দুর্বল পুঁজিবাদী’। অপরদিকে, মূলস্রোতের
বাইরেকার বামেরা এখনও একটা ক্ষীণ রূপোলী রেখা জাগিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। মাঝে
মাঝে সেটা অদৃশ্য হয় ঠিকই, কিন্তু তাঁদের অটল অধ্যবসায় আবারও তাকে অংশত দৃশ্যমান ক’রে
তোলে, গুণগত বিকাশের বিচারে সেটা আরোই চোখে পড়ে। ছত্রিশগড়ের সীমান্ত সংলগ্ন
বস্তার-বিজাপুর জেলায় ও অন্ধ্র-উড়িষ্যা-মহারাষ্ট্র জুড়ে বিস্তৃত দণ্ডকারণ্যের
বনাঞ্চলে, কিছু নৈরাজ্যবাদী বিচ্যুতি সত্ত্বেও, সি,পি,আই, (মাওবাদী)-র সামরিক-রাজনৈতিক
অগ্রগতি এর নির্ভুল প্রমাণ। সরকার যদিও তার দশপ্রহরণ নিয়ে এঁদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ
হয়েছে, কিন্তু মোদ্দা লাভ সে কিছুই ক’রে উঠতে পারে নি। এসব অঞ্চলের আদিবাসী ও
গতরখাটিয়ের দল ইতিমধ্যেই জল-জঙ্গল-জমি রক্ষার সংগ্রামে ভারত রাষ্ট্র ও তার
মদতপুষ্ট কর্পোরেট হাঙরদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে, গ্রহণ করেছে তেভাগা-তেলেঙ্গানা-নকশালবাড়ির
আলোকোজ্জ্বল পথ।
কিন্তু অন্যদিকে, সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, কিছু নকশালপন্থী
গোষ্ঠী, মূলত লিন পিয়াও-মতাবলম্বী, বিপ্লবী রণস্থল থেকে সহসা বিদায় নিয়েছে। বলা যেতে পারে, সাংগঠনিকভাবে
মুছে যাওয়া প্রজাতির মধ্যে নাম লিখিয়েছে।
আগামী পরিচ্ছেদগুলোতে আমরা এইসব লুপ্ত গোষ্ঠীর
চরিত্র ও ওঠাপড়ার ইতিবৃত্তে মনোনিবেশ করব। এ কাজ আমরা করব তাদেরই পক্ষের বা
বিপক্ষের মতামতের ভিত্তিতে।
প্রথম পরিচ্ছেদ
বপনকাল : লিন পিয়াও-পন্থী আন্দোলনের প্রথম পর্যায়
পশ্চাৎপট
১৯৭২-এর ২৮শে জুলাই লালবাজার পুলিশ
হেডকোয়াটার্সে পার্টির সাধারণ সম্পাদক চারু মজুমদার শহীদ হওয়ার পর সি,পি,আই, (এম-এল) চারু
মজুমদার-পন্থী ও চারু মজুমদার-বিরোধী দুটো উপদলে ভেঙে যায়। সত্যনারায়ণ সিংহ, ১৯৭০-’৭১ থেকেই যিনি
ভাঙাভাঙির ব্যাপারে সক্রিয় ছিলেন, চারু মজুমদার-বিরোধী প্রচারে আরও শক্তিশালী ভূমিকা নেন।
তাঁর সাথে যোগ দেন সৈফুদ্দিন (ওরফে শিবাংশু মুখোপাধ্যায়), ভাস্কর নন্দী, কৌশিক
বন্দ্যোপাধ্যায়, ধ্রুব চৌধুরী (ওরফে অলক মুখোপাধ্যায়)-র মতো তরুণ বুদ্ধিজীবীরা। সুনীতি
কুমার ঘোষ, অসীম চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষ রাণা, খোকন মজুমদারের মতো পুরনো পোড়-খাওয়া নেতারাও পার্টির
রাজনৈতিক লাইনের নিন্দায় নামেন। সবচেয়ে মোক্ষম আঘাতটা অবশ্য আসে পার্টির রাজনৈতিক
ব্যুরোর সদস্য সৌরেন বোসের তরফে, এক সময় যিনি চারু মজুমদারকে ‘ভারতীয় বিপ্লবের বিপ্লবী কর্তৃত্ব’ বলে আখ্যাত
করেছিলেন। চৌ এনলাই-এর ‘এগার দফা পরামর্শ’-এ উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি এবং তিনজন
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য—কানু সান্যাল, নাগভূষণ পট্টনায়ক ও চৌধুরী তেজেশ্বর রাও—এবং উড়িষ্যা
রাজ্য কমিটির নেতা ভুবনমোহন পট্টনায়ক ও অন্ধ্র সমন্বয় কমিটির সদস্য কোলা বেংকাইয়া
মিলে নভেম্বর ১৯৭২-এ এক খোলা চিঠি প্রকাশ করেন যেখানে চারু মজুমদারের রাজনীতি তথা
পার্টির কেন্দ্রীয় লাইনের চূড়ান্ত সমালোচনা করা হয়। স্বাক্ষরকারীরা বলেন, পার্টি মূলত বাম
হঠকারীদের বামসুবিধাবাদী লাইন অনুসরণ করেছে এবং এই বিচ্যুতির মূল দায় চারু
মজুমদারেরই। কানু সান্যাল তাঁর এক দলিলে অভিযোগ আনেন যে, রাজনৈতিক ক্যারিয়ারবাদীদের একটা
চক্র নকশালবাড়িকে তাদের ক্ষুদ্র গোষ্ঠী-স্বার্থে কাজে লাগিয়ে সারা ভারত সমন্বয়
কমিটিকে ধোঁকা দেয় ও নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের মহান ভূমিকাকে ব্যবহার ক’রে চারু
মজুমদারকে নকশালবাড়ির স্রষ্টা বলে চালাবার কাজ করে।
উলটোদিকে চারু মজুমদার-পন্থীরা ‘এগার দফা
পরামর্শ’ এবং পার্টি নেতাদের করা সমালোচনার বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি তোলেন এবং
সেগুলোকে অতি-পড়ুয়া পার্টি-বিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্রমূলক তাত্ত্বিক জালিয়াতি বলে চিহ্নিত
করেন।
দুর্ভাগ্যজনক এই বিতর্ক পার্টির নিচু তলার
কর্মীদের ভেতর ব্যাপক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। পরিস্থিতি এতদূর স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে
যে, প্রতিটা
আলোচনাই বিতণ্ডার রূপ নেয় এবং পরিশেষে ভাঙনে পর্যবসিত হয়। সংকট অনেক গভীরে তার
শিকড় চালায়, বিপ্লবী আন্দোলন এসে ঠেকে বিপর্যয়ের কিনারায়।
এই পরিস্থিতিতে, ১৯৭২-এর শেষের দিকে, পশ্চিমবঙ্গ
রাজ্য কমিটির নেতা মহাদেব মুখার্জীর নির্দেশে দু’জন চারু মজুমদার-পন্থী সংগঠক
ভবানী রায়চৌধুরী ও গৌতম ঘোষ দেখা করেন পাঞ্জাব রাজ্য কমিটির সম্পাদক ও কেন্দ্রীয়
কমিটির অতিরিক্ত সদস্য জগজিৎ সিংহ সোহাল ওরফে শর্মার সাথে। ঐ বছরের ৫-৬ ডিসেম্বর
পাঞ্জাবের রোপার জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে মহাদেব মুখার্জীর সাথে আলাপ-আলোচনা
করেন শর্মা। একগুচ্ছ দ্বিরালাপের পর ঠিক হয় কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠিত করা হবে।
মহাদেব মুখার্জীকে পদাধিকারবলে শর্মা কেন্দ্রীয় কমিটিতে কো-অপ্ট করেন ও পার্টি
কেন্দ্র পুনর্গঠিত করেন। নবগঠিত কেন্দ্র চারু মজুমদারকে ভারতীয় বিপ্লবের কর্তৃত্ব
হিসাবে ও লিন পিয়াওকে মাও সেতুং-এর পরেই আন্তর্জাতিক কর্তৃত্ব হিসাবে চিহ্নিত করে
এবং তিনটে প্রস্তাব গ্রহণ করে— (১) চারু মজুমদারের শাহাদত-এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর পরিবারবর্গের
প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে শোক প্রস্তাব; (২) চারু মজুমদার-বিরোধী হওয়ার কারণে প্রথম কেন্দ্রীয়
কমিটির নির্বাচিত সদস্য সুনীতি কুমার ঘোষ ওরফে সৌম্যকে পার্টি থেকে বহিষ্কারের
প্রস্তাব; (৩) চারু মজুমদারের ধরা পড়ার কারণ অনুসন্ধানের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন ক’রে সত্য
উদ্ঘাটন করার প্রস্তাব। ঘোষণাপত্রে শর্মা বলেন—‘আমাদের শ্রদ্ধেয় নেতার বিপ্লবী
কর্তৃত্ব চেয়ারম্যান মাও-এর আশীর্বাদপুষ্ট এবং মাও সেতুং চিন্তাধারার ওপর
প্রতিষ্ঠিত এক বিজ্ঞান। এই কর্তৃত্ব অমর... ...। আজ আমাদের কাজ শ্রদ্ধেয় নেতার
বিপ্লবী কর্তৃত্বকে দৃঢ়ভাবে জনগণের ভেতর নিয়ে যাওয়া, বিপ্লবকে সফল করা।’ বিহার রাজ্য
নেতৃত্বকারী টিমের সম্পাদক জহর ওরফে সুব্রত দত্ত-সহ সমস্ত সদস্যরা এই উদ্যোগকে
স্বাগত জানান ও নিজেদের পুনর্গঠিত কেন্দ্রের অংশ হিসাবে ঘোষণা করেন। চারু
মজুমদারের রাজনীতির ভিত্তিতে তাঁরা গড়ে তোলেন পুনপুনের কৃষক সংগ্রাম।
যাইহোক, পুনর্গঠিত কেন্দ্র উপদলবাদের
বর্ধিষ্ণু বালাইয়ের ব্যাপারে কোনও সঠিক সমাধান দিতে পারে না। কেন্দ্রীয় কমিটি
পুনর্গঠনের এক-দু মাস পরেই, পাঞ্জাবের বিপ্লবী কর্মীদের চাপে, শর্মা বিহার ও
পশ্চিমবাংলার রাজ্য নেতৃত্বের সাথে আলোচনায় বসেন। আলোচনাকালে তিনি জানান— ‘মৃত্যুর কিছুদিন
আগে কমরেড চারু মজুমদার একটি মিটিং করেছিলেন...। সেই মিটিং-এ কমরেড চারু মজুমদার
বলেন, “আন্তর্জাতিক পরামর্শ সম্পর্কে আপনারা বলুন। আমি কি করবো, আমি কিভাবে
আত্মসমালোচনা করবো?”’ শর্মা আরও জানান, ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান – কমরেড চারু
মজুমদার এটাকে প্রত্যাহার ক’রে নিয়েছেন...। চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান – এটা ঠিক নয়।
কারণ এতে শ্রেণী ও মেহনতি জনতা জাগবে না।’ গেরিলা যুদ্ধের প্রসঙ্গে শর্মা
বলেন— ‘গেরিলা যুদ্ধ একমাত্র পথ নয়, কারণ এটা সামরিক লাইন। শ্রেণীশত্রু খতম অভিযান এভাবে নয়, কোনও
গণআন্দোলনের মাধ্যমে করতে হবে, না হলে জনগণ শামিল হবেন না। গণআন্দোলন সম্পর্কে কমরেড
চারু মজুমদার নিজের আগেকার স্ট্যান্ড পালটে নিয়েছেন...’। পরে এই মত তিনি পার্টির উত্তর
ভারত কমিটির পক্ষ থেকে দলিল আকারে রাখেন।
মহাদেব মুখার্জী বা জহরের মতো কট্টর চারু মজুমদার-পন্থীরা
এই সব মতের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। শর্মাকে সমালোচনা ক’রে বিহার রাজ্য নেতৃত্বকারী টিম
সার্কুলার জারি ক’রে জানিয়ে দেয়— ‘...চারু মজুমদারের বিপ্লবী লাইনকে “মেনে” তাঁর সঠিক লাইনের মধ্যেও ভুল
খোঁজা হচ্ছে। চারু মজুমদারের বিপ্লবী লাইনকে নিঃশর্তভাবে মানার বিরোধ করার মাধ্যমে
তাঁর বিপ্লবী কর্তৃত্বকেও নিঃশর্তভাবে মানার বিরোধিতা করা হচ্ছে। তারই নির্দিষ্ট
প্রকাশ দেখা যায় কমরেড চারু মজুমদারের “আত্মসামালোচনা” ও “প্রত্যাহার”-এর নামে।’ মহাদেব মুখার্জীর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটিও
অনুরূপ অবস্থান গ্রহণ করে এবং চারু মজুমদারের প্রতিটি শব্দের বিশুদ্ধতা রক্ষায়
ব্রতী হয়। ১৫-১৮ই জুন ’৭৩ তারিখে অনুষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির বর্ধিত
অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়— ‘শ্রদ্ধেয় নেতা বিজ্ঞান, শ্রদ্ধেয় নেতা কর্তৃত্ব, শ্রদ্ধেয় নেতা
বিশ্বাস, শ্রদ্ধেয় নেতা বিপ্লব। তিনিই মহান আন্তর্জাতিক কর্তৃত্ব চেয়ারম্যানের
চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিপ্লবী কর্তৃত্ব। আমাদের পরম প্রিয় শ্রদ্ধেয়
নেতাই আমাদের চিনিয়েছেন চেয়ারম্যান মাওকে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘণ্টা প্রমাণ করছে আমাদের
শ্রদ্ধেয় নেতার জাতীয় কর্তৃত্ব ও চেয়ারম্যান মাও-এর আন্তর্জাতিক কর্তৃত্ব অভিন্ন।
তাই তো মরিয়া হয়ে ওরা দেখাতে চাইছে উভয়ের মধ্যে বিরোধ। কিন্তু ওরা যতই বিরোধ
দেখাতে চাইছে ততই বেশী ক’রে বিপ্লবী জনতা উপলব্ধি করছে তাঁদের মধ্যে কতো মিল!’
দুপক্ষের অনমনীয় আচরণে আরও একটা ভাঙন অনিবার্য
হয়ে ওঠে। বাংলা, বিহার, আসাম, দিল্লী, মধ্যপ্রদেশের ও অন্ধ্রের শ্রীকাকুলাম জেলার কমরেডরা শর্মা-পন্থীদের থেকে
নিজেদের আলাদা ক’রে নেন ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে থাকেন। বিহারে ও বাংলায় তাঁরা নিজেদের ভিত
মজবুত করেন। বেগতিক দেখে শর্মাও সরে যান ও কিছু সময় পরে বাংলার সুনীতি কুমার ঘোষ, পাঞ্জাবের শ্যাম
চোপড়া, উত্তর প্রদেশের বীরবাহাদুর ওরফে রামনাথ এবং অন্ধ্রপ্রদেশের নেতা
আপ্পালাসুরি ও কোন্ডাপল্লী সীতারামাইয়ার সাথে মিলে গড়ে তোলেন সি,পি,আই, (এম-এল) কেন্দ্র
সংগঠনী কমিটি বা সি,ও,সি, সি,পি, আই, (এম-এল)। সি,ও,সি, নেতৃত্ব মুখে চারু মজুমদারকে মেনে চলার কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে মধ্যপন্থী
অবস্থান গ্রহণ করে।
তখন অবধি সি,পি,আই, (এম-এল)-এর উপদলগুলো আগামী দিনের
বিপ্লবী সংগ্রামের রণকৌশল সম্বন্ধে তাদের পারস্পরিক মতপার্থক্যগুলো বজায় রেখেছিল
কিংবা বলা ভালো সেগুলোর মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু চিনা কম্যুনিস্ট
পার্টির দশম কংগ্রেসে লিন পিয়াও প্রসঙ্গ এসে পড়ায় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেল।
বারুদের স্তূপে ফুলকি পড়লে যেমন হয় সেভাবেই তা উপদলীয় বিদ্বেষ ও অনৈক্যের অনুঘটক
হয়ে উঠল।
লিন পিয়াও-পন্থী কেন্দ্রের উদ্ভব
দশম কংগ্রেসের রাজনীতিকে কোনও রকম
বিচার-বিশ্লেষণ না ক’রেই সি,পি,আই, (এম-এল)-এর সমস্ত মুখ্য উপদল দশম কংগ্রেসের অনুগামী হয়ে
যায়। তারা লক্ষই করে না যে, নবম কংগ্রেস, যাকে স্বয়ং মাও সেতুং বলেছিলেন বিজয়ের কংগ্রেস, তার মূল
দিকগুলোই নাকচ করেছে দশম কংগ্রেস। চৌ এনলাই-এর রিপোর্ট-এ নবম কংগ্রেসে গৃহীত মূল
মতাদর্শগত লাইন—জাতীয় মুক্তি সংগ্রামগুলোর দূর্বার গতিতে বেড়ে চলার প্রেক্ষিতে ও নিজ
সংকটের কারণে সাম্রাজ্যবাদ এবং পুঁজিবাদ অস্তগামী ও মাও সেতুং চিন্তাধারাই এ যুগের
পতাকা—নাকচ হয়ে যায়; বলা হয়, আন্তর্জাতিক পরিসরে অনেক বড় বড় পরিবর্তন ঘ’টে গেলেও লেনিনবাদই বর্তমান
দুনিয়ার মূল নিশান, এই যুগ লেনিন-এর যুগ। এছাড়া এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন অ্যামেরিকা থেকে ইউরোপ-এর
দিকে সংগ্রামের ভরকেন্দ্র সরে গেছে বলে জানানো হয়। বিষয়গত বা অবজেক্টিভ স্তরে
সাম্রাজ্যবাদের শক্তিকে বৃহৎভাবে দেখানো হয়। রিপোর্ট-এ চৌ এই আভাসও দেন যে, মার্কিন
সাম্রাজ্যবাদ একটা ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত হয়েছে এবং দুনিয়ার মূল বিপদ আসলে
সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ। মাও সেতুং-এর উত্তরাধিকারী বলে পরিচিত লিন পিয়াওকে
এই কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে মরণোত্তর বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অভিযোগ করা হয়, তিনি ক্ষমতা দখল
করার জন্য মাও-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন এবং তাঁকে খুন করার প্রচেষ্টায়
ব্যর্থ হয়ে সোভিয়েত দেশে পালিয়ে যেতে গেলে আকাশপথে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান।
গোটা দশম কংগ্রেসটাই, সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের
বিপরীতে গিয়ে, এমন ঢাকঢাক-গুড়গুড়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল যে অনেকের মনেই নানান প্রশ্ন উঁকি
মারতে শুরু করে। চেয়ারম্যান মাও-এর কোনও পূর্ণাঙ্গ বক্তব্যও বাইরের জনতার কাছে উপস্থিত
করা হয় না। শুধু জানা যায় তিনি কংগ্রেসে উপস্থিত ছিলেন।
এমতাবস্থায়, ঐ বছরের ৪ঠা সেপ্টেম্বর,
পুনর্গঠিত কেন্দ্রের তরফে এক বর্ধিত অধিবেশনের ডাক দেওয়া হয়। আগেই মতপার্থক্যের
কারণে শর্মা সরে যাওয়ায় সভা পরিচালনার ভার নেন মহাদেব মুখার্জী। অধিবেশনে উপস্থিত
শ্রীকাকুলামের দুজন কমরেড এই মর্মে বক্তব্য রাখেন যে, ‘যখন সাংস্কৃতিক বিপ্লব হয় তখন
সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, প্রতিক্রিয়াশীলরা ও সংশোধনবাদীরা দেশদ্রোহী লিউ শাওচিকে
সমর্থন করেছিল। কিন্তু আজ এরা সকলে মিলে কমরেড লিন পিয়াওকে আক্রমণ করছে। তাই এ
সম্পর্কে আমরা ভাবতে পারি যে, ভাইস চেয়ারম্যান লিন পিয়াও নিশ্চয়ই সঠিক লাইনেই রয়েছেন।’ তাঁরা আরও বলেন, ‘এতদিন চিন দেশের
খবর তাদের পার্টির মুখপত্র মারফৎ প্রকাশিত হওয়ার আগে বাইরে কখনও প্রকাশ পেত না।
কিন্তু লিন পিয়াও-এর মৃত্যু সম্পর্কিত খবর আমাদের দেশের বুর্জোয়া কাগজগুলোতে এত
আগে প্রকাশ হ’ল কি করে? সুতরাং সেখানে নিশ্চয়ই কোনও গোলমাল আছে বলে আমাদের ভাবতে হবে।’ এই অধিবেশন থেকে
মহাদেব মুখার্জীর নেতৃত্বে স্লোগান ওঠানো হয় ‘দশম কংগ্রেস জিন্দাবাদ, লিন পিয়াও
জিন্দাবাদ’। বিহারের বেশ কিছু কমরেড এবং অন্যান্য রাজ্য কমিটিগুলো এই পথ অনুসরণ করে। বস্তুতঃ, এই স্লোগান
মারফৎ মাও চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে লিন পিয়াও-এর ভূমিকাকে স্বীকার ক’রে নেওয়া হয় এবং
একই সাথে মাও-এর উপস্থিতিকে সম্মান জানিয়ে, দায়িত্বজ্ঞানহীন চিহ্নিতকরণের দিকে না গিয়ে,
ভ্রাতৃত্বমূলক পার্টির প্রতি আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন জানানো হয়; যদিও এর দ্বারা এও
বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে চিনা পার্টিতে সংশোধনবাদ থাবা বসিয়েছে এবং অষ্টম কংগ্রেসের
মতোই মাও সেতুংকে জোর ক’রে চুপ করিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু জহরের নেতৃত্বাধীন বিহার রাজ্য
নেতৃত্বকারী টিমের অধিকাংশ কমরেডরা এই মতের বিরোধিতা করেন। তাঁরা বলেন, যে পার্টিকে
চেয়ারম্যান মাও বলেছেন ‘গ্রেট, গ্লোরিয়াস অ্যান্ড কারেক্ট’, যে কংগ্রেসে তিনি নিজে উপস্থিত
থেকেছেন, সেখানে ‘লিন পিয়াও জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেওয়া এক ঘৃণ্য অপরাধ। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির
অন্তর্গত বাংলা-বিহার সীমান্ত আঞ্চলিক কমিটির কমরেডরা আবার মহাদেব মুখার্জীকে
উলটোদিক থেকে আক্রমণ করেন। তাঁরা অভিযোগ আনেন এই বলে যে, যেখানে মাও চিন্তাধারার মূল
বিষয়বস্তু দশম কংগ্রেস অস্বীকার করেছে, যেখানে নবম কংগ্রেসের সঠিক লাইন হয়েছে অস্বীকৃত এবং
ধিক্কৃত হয়েছেন মাও সেতুং-এর প্রধান উত্তরাধিকারী লিন পিয়াও, সেখানে দশম
কংগ্রেসকে লাল সেলাম জানানো মানে বিলোপবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া। এর পর বাংলা-বিহার
সীমান্ত আঞ্চলিক কমিটি পার্টির সাথে সব সম্পর্কে ছিন্ন করে।
বিহার রাজ্য নেতৃত্বকারী টিমের সমালোচনার
বিরুদ্ধে মহাদেব মুখার্জী কোনও নীতিনিষ্ঠ দু’লাইন চালান না। পরিবর্তে তিনি বিহারের
আর এক চারু মজুমদার-পন্থী নেতা সুরযের সাথে যোগাযোগ করেন ও তাঁর প্রভাবাধীন জেলা
আরা, ধানবাদ, গয়া ও গিরিডির
কমরেডদের নিয়ে ’৭৩-এর সেপ্টেম্বর মাসে বিহার রাজ্য সম্মেলন করেন। পাটনা জেলার কয়েকজন
কমরেডও এতে যোগ দেন। সবকটা রাজ্যে সম্মেলন শেষ হলে লিন পিয়াও-পন্থীরা মহাদেব
মুখার্জীর নেতৃত্বে এক কেন্দ্র সংগঠনী কমিটি গড়ে তুলে সিদ্ধান্ত নেয় সি,পি,আই, (এম-এল)-এর
দ্বিতীয় (নবম) পার্টি কংগ্রেস করার, যা অনুষ্ঠিত হয় ঐ বছরের শেষের দিকে—হুগলী-বর্ধমান
জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম কামালপুরে।
পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ‘ভারতের
জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সমগ্র পর্যায় জুরে পুরনো কর্মসূচীই একমাত্র সঠিক কর্মসূচী
এবং এই কর্মসূচীই কমরেড লিন পিয়াও-এর অভ্রান্ত লাইনকে অত্যন্ত যথাযথভাবে এবং
সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরে।’ অধিকন্তু, ‘গেরিলা যুদ্ধই শত্রুর বিরুদ্ধে জনগণের সমস্ত শক্তিকে
চালিত ও প্রয়োগ করার একমাত্র পথ।’ কংগ্রেসে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটি ও তার সম্পাদক
মহাদেব মুখার্জী ঘোষণা করেন, ‘শ্রদ্ধেয় নেতার প্রতি জ্বলন্ত বিশ্বাস না থাকলে বিপ্লবী
থাকা যায় না। জ্বলন্ত বিশ্বাস না থাকলে প্রাণ দান করা যায় না। শ্রদ্ধেয় নেতার
চিন্তাধারা, চেয়ারম্যানের চিন্তাধারা বিজ্ঞান। একে নিঃশর্তভাবে মেনে নিয়েই প্রয়োগে যেতে
হবে।’
জয় ও ব্যর্থতা
বহু ভাঙন ও অভ্যন্তরীণ সংকট সত্ত্বেও মহাদেব
মুখার্জীর পরিচালনাধীন লিন পিয়াও-পন্থী কেন্দ্র সি,পি,আই, (এম-এল) নামধারী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে
সবচেয়ে সক্রিয় হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। দলের কর্মীরা পশ্চিমবাংলার প্রায়
সাতটা জেলায় গেরিলা ঘাঁটি তৈরি করেন ও বিপ্লবী কমিটির শাসন লাগু করেন। গ্রামগুলোতে
ব্যাপকভাবে ফসল কাটা শুরু হয়। শুরু হয় জোরদার গেরিলা অ্যাকশন। কামালপুর, কালিনগর, শেওড়াফুলি, পেটুয়াভাঙা, হলদিয়া, তমলুক, বালিচক, খড়গপুর ইত্যাদি
জায়গা মজবুত লিন পিয়াও-পন্থী ঘাঁটি বলে পরিচিত হয়। ’৭৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে, জোতদার-জমিদার
বাদে, পুলিশ, রেলওয়ে সুরক্ষা বাহিনী ও জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর উনিশ জন কর্মী খতম হয়, দখল করা হয় মোট
তিরিশখানা সরকারী আগ্নেয়াস্ত্র। লিন পিয়াও-পন্থীদের সবচেয়ে বড় প্রভাব দেখা যায়
কামালপুরে। ’৭৪-এর জুন-জুলাই নাগাদ যখন পুলিশ কামালপুর রেইড করে, সেখানকার
আবালবৃদ্ধবনিতা হাতে অস্ত্র তুলে নেয় ও পুলিশের সাথে লড়াই করে যাতে ঘেরাও ভেঙে
গেরিলা স্কোয়াড এবং বিপ্লবীরা পালাতে সক্ষম হন। মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুরে পার্টির
সভায় যোগদান করতে গিয়ে মহাদেব মুখার্জী যখন এই খবর পান, আবেগমথিত কণ্ঠে তিনি বলে ওঠেন—‘কামালপুর আজ
ভিয়েতনামের স্তরে উঠেছে’।
কিন্তু লিন পিয়াও-পন্থীদের এই জয় দীর্ঘস্থায়ী
হয় নি। সিদ্ধার্থশংকর রায়ের সরকার তাঁদের ওপর তুমুল আক্রমণ নামিয়ে আনে এবং পার্টির
সমস্ত প্রতিরোধ চূর্ণ ক’রে দেয়। গেরিলা অ্যাকশনের জবাবে পুলিশ বারোজন বিপ্লবীকে
খুন করে। খুন হন আদিবাসী কর্মী লদ হেমব্রম, নিরাপদ হেমব্রম এবং হলধর কিস্কু। ’৭৪-এর ২রা জুলাই
ই,এফ,আর, ক্যাডেটরা খুন
করে পার্টির দুজন নির্ভীক সৈনিককে। তাঁরা হলেন মনোতোষ চক্রবর্তী ও রামশংকর ব্যানার্জী।
একই দিনে শহীদ হন তাঁদের নেতা জিতেন কুণ্ডু, যিনি কমরেড কাবুলদা নামে অধিক
পরিচিত ছিলেন। অকুস্থল ছিল হুগলীর ত্রিবেণী ঘাট এলাকা। ১৯৭৪-এর শেষাশেষি পুলিশ মোট
২৯টা আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে এবং তাদের হাতে গ্রেপ্তার হন প্রায় ১২৭০ জন সক্রিয়
কর্মী।
কিন্তু এ সব পরাজয় থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হন
মহাদেব মুখার্জী। যে কথাগুলো লড়াইয়ের শুরুর দিনগুলোতে বলতেন, সেগুলোই আউড়ে
চলেন অনবরত। আউড়ে যান ‘হাজার হাজার মুক্তাঞ্চল’ গড়ে তুলে ’৭৫ সালের মধ্যে
দেশকে মুক্ত করার হঠকারী লাইন। চারু মজুমদার শহীদ হওয়ার পর অবস্থা এতটাই জটিল হয়ে
গিয়েছিল যে ধৈর্য ধরে শ্রেণীর মধ্যে পার্টিকে আরও একবার প্রথিত করার দরকার ছিল
অতীত সংগ্রামের সারসংকলনের ভিত্তিতে। কিন্তু ১৯৬৭ থেকে ’৭২-এর লড়াইয়ের কোনও সারসংকলন মহাদেব
মুখার্জী করেন নি। তিনি অত্যন্ত একগুঁয়েভাবে চারু মজুমদারের প্রতিটা শব্দের
বিশুদ্ধতা রক্ষার নামে তাঁর যান্ত্রিক মূল্যায়ন করেছিলেন, অনধীত থেকে গেছিল তাঁর রচনাবলীর
রাজনৈতিক মর্মবস্তু।
মহাদেব মুখার্জীর একগুঁয়েমির জন্য পার্টি কংগ্রেসে
নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটির আমলে যে সব লড়াই পরিচালিত হয়েছিল তার প্রসার রুদ্ধ হয়ে
যায়। সব কিছু যেন ভেঙে পড়তে থাকে। যে সব কমরেড এক সময় তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন
এবং তাঁকে প্রায় নরদেবতা বানিয়ে ফেলেছিলেন, তাঁরাই এবার তাঁর বিরুদ্ধে
বিদ্রোহে শামিল হন। তাঁরা এতটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে মহাদেব মুখার্জীর সাথে লিন
পিয়াওকেও আক্রমণ করতে ছাড়েন না। অচিন মাল বাদে গোটা কেন্দ্রীয় কমিটিই তাঁর ও লিন
পিয়াও-এর বিরোধিতায় মুখর হয়। ৩রা নভেম্বরের (’৭৪) দেগঙ্গা অধিবেশনে মহাদেব
মুখার্জীর বিরুদ্ধে চার্জ দায়ের করা হয়। সম্পাদকের পদ থেকে তিনি অপসারিত ও
উত্তরপূর্বে নির্বাসিত হন। বাংলা ছেড়ে মেঘালয়ের লবণে তিনি আশ্রয় নেন ও পরে সেখান
থেকে চলে যান শিলঙে। শেষে, ১৯৭৪-এর ডিসেম্বর মাসে, পার্টির রাজনৈতিক ব্যুরোর অন্যতম
সদস্য সত্যব্রত দত্ত পুলিশের কাছে মুখ খুলতে বাধ্য হওয়ায় তিনি গ্রেপ্তার হন। জেলে
থাকাকালীন মহাদেব মুখার্জী এবং কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যান্য সদস্যরা আত্মসমর্পণ করেন
বলে শোনা যায়।
মহাদেব মুখার্জীর পদচ্যুতির পর সাধারণ সম্পাদক
হন বিহার রাজ্য কমিটির সম্পাদক সুরয। কিন্তু কিছু মাস পরেই তিনি পার্টির সংশ্রব
ত্যাগ করেন ও পরে সি,পি,আই, (এম-এল) পার্টি ইউনিটি নামে এক উপদল গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে এই উপদল সোহালের
সি,ও,সি, ও মহাদেব
মুখার্জীর আর এক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ভবানী রায়চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী
ইউনিটি অর্গানাইজেশনের সাথে মিলে যায় ও নতুন ক’রে সি,পি,আই, (এম-এল) পার্টি ইউনিটি নাম নেয়।
১৯৯৮ সালে সি,পি,আই, (এম-এল) পিপলস ওয়ার-এর সাথে এই সংগঠন সংযুক্ত হয়।
সুরজের বেরিয়ে যাওয়া, পার্টির সম্পাদক-সহ বাকি কেন্দ্রীয়
কমিটি সদস্যদের ধরা পড়া, গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়া কেন্দ্রীয় কমিটির একাংশের মদতে লিন
পিয়াও-সহ মহাদেব মুখার্জীর নামে কুৎসা রটানো ইত্যাদির কারণে বাইরে যাঁরা ছিলেন
তাঁরা লিন পিয়াও এবং মহাদেব মুখার্জীর প্রতি বিশ্বস্ত থেকে এক কেন্দ্রীয় সমন্বয়
কমিটি গড়ে তুলে কাজ চালাতে শুরু করেন। ৯-১০ এপ্রিল, ’৭৬ তারিখে তাঁরা আলোচনায় বসেন
শান্তি পাল পরিচালিত বাংলা-বিহার সীমান্ত আঞ্চলিক কমিটির কমরেডদের সঙ্গে। কিন্তু
বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য থাকায় ঐক্য সম্ভব হয় না। শান্তি পাল গোষ্ঠী এর পরে
নিজেদের এক কেন্দ্র সমন্বয় কমিটি গড়ে তোলে।
জেলের ভেতরে লড়াই
চারু মজুমদার বেঁচে থাকতেই, কলকাতা ও
দক্ষিণবঙ্গের জেলে থাকা বিপ্লবীরা জেলের ভেতরে, বিশেষত আজিজুল হক, নিশীথ
ভট্টাচার্য ও সুনীল (ওরফে অর্জুন) ব্যানার্জীর নেতৃত্বে, নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করেন।
তৈরি হয় জেল পার্টি কমিটি বা জে,পি,সি,। ’৭২ পরবর্তী সময়ে প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ জে,পি,সি,-ই ছিল লিন
পিয়াও-পন্থীদের হাতে। সেগুলো প্রায় সকটাই মহাদেব মুখার্জীর ও লিন পিয়াও-এর পক্ষে
দাঁড়ায় ও দেগঙ্গা লাইনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে। জেলে থাকাকালীন দেগঙ্গা
লাইনের কমরেডদের পরিণতি হয়েছিল ভয়াবহ। ঐ লাইনের অন্যতম অনুগামী ও পরবর্তীতে সি,পি,আই, (এম-এল) পার্টি
ইউনিটি নেতা গৌতম ঘোষ জানিয়েছেন তাঁর সহকর্মী ও দেগঙ্গাপন্থী নেতা ভবানী
রায়চৌধুরীর কথা, যিনি জেল থেকে বেরিয়ে ইউনিটি অর্গানাইজেশন তৈরি করেন ও পরে সি,পি,আই, (এম-এল) পার্টি
ইউনিটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। — ‘আমি স্পেশাল জেল থেকে বন্ধুদের প্রচেষ্টায় প্রেসিডেন্সি
জেলে যাই—সাতখাতায়। সেখানে দেখি ভবানীদা একটা কোনে বসে আছেন আর নিবিষ্ট মনে একটা বই
পড়ছেন, বইটার শিরোনাম ম্যাথম্যাটিকস ফর দি মিলিয়নস, দেখলাম আঁকাজোকা করছেন। আর দেখলাম
ওঁর সামনে অনেকগুলো মোটা মোটা ডকুমেন্টস, যেগুলো আই,বি, সিজ করেছে—মাও সেতুং থেকে শুরু ক’রে চারু মজুমদার পর্যন্ত। সেগুলো
ভবানীদাকে দিয়েছে। দিয়ে বলেছে—নাউ ইউ নেগেট সি,এম, উইথ সি,এম, থট। এইটে আপনার একমাত্র কাজ। উনি
অশ্রুজল চোখে বললেন, আমি এই কাজটায় রাজী হয়েছি।’ দেগঙ্গাপন্থীদের সাথে ডিবেটের ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে
চারু মজুমদার বিরোধীদের দিক থেকে ধেয়ে আসা কুৎসার বিরুদ্ধে মতাদর্শগত লড়াই। পুলিশি
অত্যাচার, দেগঙ্গা-পন্থী ও লিন বিরোধীদের কুৎসা, চারু মজুমদার বিরোধীদের বল্গাহীন
আক্রমণ - প্রায় সব ফ্রন্টেই লড়তে হয় লিন পিয়াও-পন্থী জে,পি,সি, সদস্যদের।
চারু মজুমদার ও লিন পিয়াও-পন্থীদের ভেতর জেল
ভাঙা এক সাধারণ অনুশীলন হিসাবে আসে শুরু থেকেই। এমনকি চারু মজুমদার-পন্থী অথচ লিন
পিয়াও-বিরোধীরাও জেল ভাঙার পক্ষে দাঁড়ান। অবিভক্ত সি,পি,আই, (এম-এল)-এর যুগে, ’৭১ সাল নাগাদ, পশ্চিমবঙ্গ
রাজ্য কমিটির সম্পাদক শরৎ ওরফে সরোজ দত্ত জেলের কমরেডদের উদ্দেশ্যে যে সার্কুলার
পাঠান ও আজিজুল হকের প্রশ্নের উত্তরে যে চিঠি লেখেন তাতে বলা হয়েছিল জেলের ভেতরে
কম্যুনিস্ট থাকতে হবে এবং সেই কারণে সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে, জেল ভেঙে বা
অন্যভাবে বেরিয়ে এসে বাইরের লড়াইয়ের সাথে যুক্ত হতে হবে। তাই বন্ড বা মুচলেকা দিয়ে
নয়, বিপ্লবীরা
জেল থেকে বেরিয়ে আসবেন জেল ভেঙে, আইনি পথকে অস্বীকার করে। চারু মজুমদারের মৃত্যুর পরেও জে,পি,সি, সদস্যরা এই
লাইনে দৃঢ় থাকেন। ১৯৭৩ থেকে ’৭৬-এর মধ্যে বেশ কিছু সাফল্য ও ব্যর্থতার ঘটনা রয়েছে
লিন পিয়াও-পন্থীদের জেল বিদ্রোহের আখ্যানে।
প্রথম ঘটনা ঘটে ৭ই জুলাই, ১৯৭৩-এ, দমদম সেন্ট্রাল
জেলে। চার জন লিন পিয়াও-পন্থী বিপ্লবী (সেল নং ১৬) রাত ১১টা নাগাদ কারা কক্ষের
দেয়াল ভেঙে, ধীরে ধীরে ইট সরিয়ে, বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রহরারত
সেন্ট্রিদের তৎপরতায় উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
দ্বিতীয় ঘটনা এক চরম ব্যর্থতার উপাখ্যান।
১৯৭৩-এর ১লা অক্টোবর আলিপুর সেন্ট্রাল জেল ভাঙার চেষ্টা করেন সেখানকার কয়েকজন লিন
পিয়াও-পন্থী বন্দী। কিন্তু অ্যাকশন প্ল্যান ব্যর্থ হওয়ায় তাঁরা সকলেই গুরুতর আহত
হন। বাইরে থেকে তাঁদের যাঁরা সাহায্য করতে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে সঞ্জয় বসু রায়
নামে এক তরুণ ইঞ্জিনীয়র শহীদ হন। যাঁরা গ্রেপ্তার হন তাঁরা হলেন বাবলু, শক্তি, টুনু, বিজন, অনিমেষ, তপন, অসিত, রাজর্ষি এবং
মীনাক্ষী।
পরের ঘটনা একাধারে সাফল্যের ও শহীদ হওয়ার। ৬ই
মে, ১৯৭৪। স্থান,
কৃষ্ণনগর সাব জেল। রাত ৯টা নাগাদ বন্দীদের খাবার দেওয়ার সময় ন’জন লিন পিয়াও-পন্থী
বিপ্লবী হঠাৎই পিস্তল নিয়ে কারারক্ষীদের ওপর চড়াও হন এবং জেল গেটের চাবি ছিনিয়ে, সান্ত্রীদের
দিকে গুলি ছুঁড়ে পালিয়ে যান। পুলিশের পালটা গুলিতে নিহত হন বিপ্লবী কালিপদ সাহা।
যে আটজন পালাতে সক্ষম হন তাঁরা হলেন গোরা ভট্টাচার্য, কদর শেখ, অনুপ মণ্ডল, কালিমোহন পাল, দিপেন সরকার, সমীর বিশ্বাস, চরণ ঘোষ, আবদুল হালিম ও
শ্যামল কর্মকার।
পরের অ্যাকশন এক বড়সড় ব্যর্থতা ডেকে আনে। ৩রা
মে, ১৯৭৫।
হাওড়া সাব-জেলের পাঁচজন লিন পিয়াও-পন্থী নকশাল বন্দী ভোর ৬টা নাগাদ গেট ওয়ার্ডারের
ওপর লংকা গুড়ো ছিটিয়ে চাবি কেড়ে নেন ও বাইরের গেটের তালা খুলে ফেলেন। কিন্তু
পালানোর আগের মুহূর্তে জেল কর্তৃপক্ষ মুহুর্মুহুর গুলি বৃষ্টি করে এবং হাওড়া জেলা
কমিটির নেতা ও বন্দী কমরেডদের কম্যান্ডার ভ্রমর মণ্ডল-সহ বাকি চারজনকে খুন করে।
নিহত বাকি চারজন হলেন প্রবীর রায়চৌধুরী, প্রতীপ ঘোষ, তরুণ দাস ও মদন দাস।
এই সময় সুনীল ব্যানার্জীর নেতৃত্বে শিয়ালদা
কোর্ট লকআপ ভেঙে কয়েকজন লিন পিয়াও-পন্থী বিপ্লবী পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
২৪এ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬। প্রতিবিপ্লবী জরুরী অবস্থার
যখন রমরমা, সেই সময়, বাইরের পার্টি কমিটির সামান্যতম সাহায্য ছাড়াই, সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে ৪৩জন
লিন পিয়াও-পন্থী কারাধীন বিপ্লবী প্রেসিডেন্সী কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙে রাষ্ট্রের
উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। সদর দরজায় বোমা মেরে, দুজন সেপাইকে খতম ক’রে ৪৫জন বিপ্লবী
এক নাগাড়ে বোমা চার্জ করতে করতে কলকাতার কর্মচঞ্চল রাস্তা ধরে পালিয়ে যান। এই
অ্যাকশনে শহীদ হন মহাদেব মুখার্জীর ব্যক্তিগত সংবাদ-বাহক স্বদেশ ঘোষ এবং হাওড়া
জেলা পার্টির নেতা কালু হালদার। সেদিন যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ নকশালপন্থী নেতৃত্ব
প্রেসিডেন্সী জেল পালাতে সক্ষম হন তাঁরা হলেন নিশীথ ভট্টাচার্য, আজিজুল হক, অজিত চক্রবর্তী, ডাঃ ইন্দ্রনাথ
বক্সী, কিশলয় ব্রহ্ম, স্বপন সাহা ও তাপস সরকার। কিন্তু বাইরের পার্টি তখন এতটাই দুর্বল ছিল যে
তারা পলাতকদের জন্য ঠিকঠাক কোনও শেল্টারের ব্যবস্থা ক’রে উঠতে পারে নি। ফলস্বরূপ ২৭জন
বিপ্লবী কয়েক মাস পরেই আবার গ্রেপ্তার হন। অকথ্য অত্যাচার করা হয় তাঁদের। সবাইকে
ডাণ্ডা-বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়, ইলেকট্রিক হিটারে পা পুড়িয়ে দেওয়া হয় আজিজুল হকের।
কিন্তু শত অত্যাচারের সামনেও লিন পিয়াও-পন্থী বিপ্লবীরা নতিস্বীকার করেন নি। আগের
মতই তাঁরা লড়াই করেছিলেন পুলিশি অত্যাচারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত
বিষয় নিয়ে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
অগ্নিঝলক : লিন পিয়াও-পন্থী আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়
দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির জন্ম
’৭৭ সালে
ইন্দিরা-সিদ্ধার্থ দুষ্ট-বন্ধনীর শাসনের অবসান হলে কেন্দ্রে ও রাজ্যে যথাক্রমে আসে
জনতা সরকার ও সি,পি,আই, (এম) পরিচালিত বামফ্রন্ট। ’৭৮-এর প্রথম দিকে পশ্চিমবাংলার প্রায় সমস্ত নকশাল বন্দীকে
মুক্তি দেওয়া হয়। বস্তুতঃ, নকশাল বন্দীদের মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েই বামফ্রন্ট
ক্ষমতায় এসেছিল।
’৭৭-এর
আগস্ট থেকে লিন পিয়াও-পন্থীরা পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করেন। এই উদ্দেশ্যে তাঁদের
জেলের সংযোগ সূত্রগুলোকে কাজে লাগান। সর্বক্ষণের কর্মী হতে চান যাঁরা, তাঁদের পাঠিয়ে
দেওয়া হয় বিভিন্ন জেলায়, নতুন ক’রে পার্টি গড়ে তোলার কাজে। আজিজুল হক যান
উত্তরবঙ্গে, এবং গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ স্থাপনে সফল হন। তার পর তিনি যান নদীয়ায়, সেখানকার
সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলতে। গোরা ভট্টাচার্যকে পাঠানো হয় বিহারের জামালপুরে, রেলওয়ে শ্রমিক ও
কর্মচারীদের ভেতর সংগঠন করার জন্য। পরে সুনীল ব্যানার্জীকে বিহার রাজ্য কমিটির
দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। আস্তে আস্তে পার্টি কমিটি গড়ে ওঠে আসাম, ত্রিপুরা এবং
উত্তরপ্রদেশে।
কেন্দ্র পুনর্গঠিত ক’রে সমগ্র পার্টি এবং সমর্থকদের
ঐক্যবদ্ধ করতে গিয়ে মতাদর্শগত সংগ্রামে রাজনৈতিক সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন
লিন-পন্থীরা। চিনের ‘অতি-আধুনিক সংশোধনবাদী’-দের রাজনীতির মুখোশ খুলে দিতে কেন্দ্রীয় কমিটির বাংলা
মুখপত্র ‘দেশব্রতী’র পাতায় ‘সমীক্ষা’ নামে একটা কলম চালু করা হয়। সমগ্র পার্টিকে এক দৃঢ় রাজনৈতিক ভিতের ওপর দাঁড়
করানর ক্ষেত্রে সেদিন ‘দেশব্রতী’র ভূমিকা ছিল অনবদ্য। ‘সমীক্ষা’-র প্রধান লেখক ছিলেন আজিজুল হক।
বলা যেতে পারে, আজিজুল হক-ই প্রথম লিন পিয়াও-পন্থী নেতা যিনি লিনের রাজনৈতিক ও সামরিক
লাইনের সৃজনশীল দিকগুলো পুনরাবিষ্কার করেন এবং মানুষের সামনে তুলে ধরেন। সাথে সাথে
তিনি চৌ-তেং-হুয়া চক্র ও তার ভারতীয় অনুগামীদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা চোখে আঙুল
দিয়ে দেখিয়ে দেন।
’৭৮-এর
জানুয়ারি মাসে মহাদেব মুখার্জী জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসেন। এই পরাজয়বাদী মানসিকতার
জন্য বিপ্লবীরা তাঁর তীব্র সমালোচনা করেন। আজিজুল হকের পরিচালনাধীন ‘দেশব্রতী’
টিমের কমরেডরা তাঁর নেতৃত্ব স্বীকার করতেই রাজী হন না। সেদিন মহাদেব মুখার্জীকে
সর্বোচ্চ নেতা হিসাবে পুনর্বাসিত করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন বিহারের
দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সুনীল ব্যানার্জী। ‘দেশব্রতী’ টিমের কমরেডদের সম্পর্কে তিনি শ্লেষ ক’রে বলেন, ‘মহাদেব
মুখার্জীর কর্তৃত্ব স্বীকার করতে দেশব্রতীর হাঁটু কাঁপছে।’
নানান বাদানুবাদের পর মহাদেব মুখার্জী
পুনর্গঠিত পার্টি কেন্দ্রের সম্পাদক পদ গ্রহণ করেন। ১৭।০১।৭৮ তারিখে দমদমে এক গোপন
সভা অনুষ্ঠিত হয় তাঁকে প্রধান বক্তা করে। সেখানে তিনি ‘চিনের রং পালটাবে না’, ‘চিন কখনও রুশ
হবে না’ জাতীয় মধ্যপন্থী লাইন উপস্থিত করেন, যদিও একই সাথে চিনা কম্যুনিস্ট
পার্টির দশম এবং একাদশ কংগ্রেসের রিপোর্টের বিরোধিতা করেন ও লিন পিয়াও-এর পক্ষে
দাঁড়ান। ঐ বছরের ২৪এ ফেব্রুয়ারি পুনর্গঠিত কেন্দ্রের প্রথম অধিবেশনে ‘বিশ্ব
সংশোধনবাদের আক্রমণ ও আমাদের কাজ’ শীর্ষক প্রস্তাব গৃহীত হয়।
মহাদেব মুখার্জীর অনুরোধে তাঁর প্রাক্তন
সহকর্মী গৌতম ঘোষ, ভবানী রায়চৌধুরীর সঙ্গে ঐক্য আলোচনায় বসে পুনর্গঠিত কেন্দ্র। কিন্তু কোনও
ফল হয় না। তত দিনে তাঁরা সকলেই কট্টর লিন পিয়াও ও চারু মজুমদার-বিরোধীতে পরিণত
হয়েছেন। শান্তি পালের কেন্দ্র সংগঠনী কমিটির সাথে তিন দফা আলোচনা হয়, কিন্তু ঐক্যের
ক্ষেত্রে শান্তি পাল পুরনো ডিবেটের প্রসঙ্গ তুলে বাধা দিতে থাকেন। এমনতর অবস্থায়
তাঁর দুই কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইন্দ্র (ওরফে সুবীর তালুকদার) এবং নিরঞ্জন (ওরফে
অনিল বরন রায়), বহু সংখ্যক কমরেডকে নিয়ে, শান্তি পালের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন ও মূলধারার সাথে
সংযুক্ত হন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে এঁদের দুজনকে কো-অপ্ট করা হয়। পার্টিতে এসে ইন্দ্রর
নাম হয় সুজিত (এবং মিহির), নিরঞ্জনের রঞ্জন। সুজিতকে দেওয়া হয় উত্তরবঙ্গ জোনাল
কমিটির দায়িত্ব, রঞ্জন চলে যান পূর্ব বিহারের দায়িত্বভার নিয়ে।
সব কিছু যখন ঠিকঠাক এগোচ্ছে মহাদেব মুখার্জী
তখন কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাঁর নতুন লাইন হাজির করেন, যা তাঁর পূর্বকার ভাবনার সম্পূর্ণ
বিপরীত। এক দিকে তিনি শ্রেণীশত্রু খতমের বিরোধিতা করেন, অপর দিকে গণমুক্তি বাহিনীকে
অস্ত্রে সজ্জিত ক’রে বিপ্লবী কমিটি গড়ে তোলার পরিবর্তে নিরস্ত্র বিপ্লবী কমিটির লাইন হাজির
করেন। ‘চেতনায় মুক্তাঞ্চল’ গড়ে ওঠার এক অদ্ভুত তত্ত্ব উপস্থিত করেন তিনি। বিতর্ক না
মেটা অবধি তিনি ‘হুইপ’ জারি ক’রে ‘সমীক্ষা’ প্রকাশ বন্ধ ক’রে দেন।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদের এহেন ইতর উপস্থাপন
অধিকাংশ সদস্যকেই ক্রুদ্ধ করে। আজিজুল হকের নেতৃত্বে এই লাইনের বিরুদ্ধে প্রবল দুই
লাইনের সংগ্রাম শুরু হয়।
বিতর্ক যখন চলছে, ’৭৮-এর অক্টোবর নাগাদ, বিহারের কাটিহার
জেলার মনিহারীতে জনৈক জোতদার বি,এন, ওঝা-কে পার্টির পরিচালনাধীন একটি স্কোয়াড খতম করে ও তার
বিষয়সম্পত্তি কৃষক জনগণের মধ্যে বিলি ক’রে দেয়। এবার মহাদেব মুখার্জী খোলাখুলিই খতম লাইনের
বিরোধিতা করেন ও কেন্দ্রীয় কমিটিকে জোর করেন এর বিরুদ্ধে অননুমোদনসূচক প্রস্তাব
গ্রহণ ক’রে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিতে। বাকি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের কাছে এই আচরণ
অসহ্য মনে হয়। এবার তাঁরা ফুঁসে ওঠেন ও মহাদেব মুখার্জীকে তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ সহযোগে
বহিষ্কার করেন। বহিষ্কৃত হয়ে মহাদেব মুখার্জী তাঁর অনুগামীদের নিয়ে একটা ছোট্ট দল
খোলেন ও নিত্যনতুন উপাধিতে নিজেকে ভূষিত করতে থাকেন—যেমন ‘অন্তরের নেতা’, ‘বিশ্ব বিপ্লবের
কর্ণধার’ ইত্যাদি।
১৯৭৮-এর নভেম্বরে সর্বসম্মতিক্রমে নিশীথ ভট্টাচার্য
সংগঠনের দায়িত্ব নেন। ‘বদ রক্ত’ মুক্ত নতুন কেন্দ্র নিজেকে সি,পি,আই, (এম-এল)-এর দ্বিতীয় কেন্দ্রীয়
কমিটি বলে পরিচয় দেয়, যা নাকি পার্টির দ্বিতীয় (নবম) কংগ্রেসে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটির
পূর্বানুবৃত্তি।
বিদ্রোহ আজ!
নিশীথ ভট্টাচার্য যখন পার্টির কার্যভার গ্রহণ
করেন তখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে ব্যাপক ডামাডোল। ’৭৯-এর শুরুতে
কম্বোডিয়াতে ভিয়েতনামী সামরিক বাহিনীর অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র ক’রে শুরু হয়
চিন-ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এতদিন চিনের রং বদলের ছবি পার্টির তরফে সেভাবে উপস্থিত করা
সম্ভব হয় নি মহাদেব মুখার্জীর মধ্যপন্থী অবস্থান ও সাধারণ পার্টি কর্মীদের আবেগের
কথা মাথায় রেখে। কিন্তু এই বৃহৎ শক্তিসুলভ আচরণ ও ফ্র্যাটারনাল পার্টিগুলোর
মতামতকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি নেতৃত্ব চিনকে সামাজিক
সাম্রাজ্যবাদী বলে অভিযুক্ত ক’রে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। সোভিয়েত সামাজিক
সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার রাষ্ট্র ভিয়েতনাম ও ‘তিন বিশ্বের তত্ত্ব’ উপস্থিত করা
মার্কিন-বান্ধব চিনের ভেতরের এই লড়াইকে কেন্দ্র চিহ্নিত করে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন
আমেরিকার বাজারের দখল নিয়ে দুই কুকুরের কামড়া-কামড়ি হিসাবে।
নিশীথ ভট্টাচার্য সাধারণ সম্পাদক হওয়ার অতি
অল্প সময়ের মধ্যেই পশ্চিমবাংলা, বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় শুরু হয়
শ্রেণীশত্রু খতমের আন্দোলন। শ্রেণী রাজনীতিতে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ায় গরীব-ভূমিহীন
কৃষকের ঘর থেকে এই পর্যায়ে একাধিক যোদ্ধা, কম্যান্ডার ও সংগঠক বেরিয়ে আসেন।
তাঁরা নিজেদের যোগ্যতা বলে স্থান ক’রে নেন বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটির নেতৃত্বে।
’৭৯-র ১৪ই
জুন আদিবাসী গেরিলা যোদ্ধা শ্যাম (ওরফে রাম) হাসদা শহীদ হলে বাংলায় খতম অভিযানের
জলকপাট খুলে যায়। ভেঙে যায় গত ক’বছরের সংগ্রাম বিমুখ স্থিতাবস্থা। দিনাজপুরের শ্রীমতী
নদীর তীরবর্তী মহেন্দ্রহাট এলাকার এক বড় জোতদার, জ্যোতিশ্বর প্রধানকে খতম করতে
গিয়ে অসফল হয়ে পিছু হটার সময় শ্যাম তাঁর স্কোয়াড-সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।
আর একজন স্থানীয় জোতদার ও সুদের কারবারি, সন্তোষ দত্ত, এই সুযোগে স্থানীয় আর,এস,পি, ক্যাডারদের সাথে মিলে তাঁকে
প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে খুন করে। পার্টির লোক্যাল ইউনিট এই ঘটনায় অত্যন্ত বিহ্বল
হয়ে পরে। বিশদ আত্মসমালোচনার পর প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দিন কয়েক পর
ক্ষিপ্ত কৃষক গেরিলাদের এক স্কোয়াড সন্তোষ দত্তর বাড়ি ঘিরে ফেলে তাকে খতম করে।
চব্বিশ ঘণ্টারও বেশী সময় ধরে তার লাশ পড়ে থাকে সামনের রাস্তায়। মৃতদেহ স্পর্শ করা
বা দাহকার্যের জন্য শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সাহস দেখায় না কেউ। খবর পেয়ে সমস্ত
স্থাবর-অস্থাবর ফেলে জ্যোতিশ্বর প্রধান পালিয়ে যায় কলকাতায়। তার সম্পত্তি ভূমিহীন
ও দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে ভাগ ক’রে দেয় স্থানীয় বিপ্লবী কমিটি।
এই ঘটনা যেন স্ফুলিঙ্গ হয়ে উত্তরবাংলার গ্রামে
গ্রামে কৃষক বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে দেয়। খতম অভিযান শুরু হয় কোচবিহারের
দিনহাটা-সংলগ্ন গ্রামগুলোতে, ঢেউ গিয়ে পড়ে জলপাইগুড়ি জেলায় ও দিনাজপুরের ইটাহারে।
রাজ্যের প্রায় সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এর জের। দক্ষিণবঙ্গেও তৈরি হয় অনুরূপ
পরিস্থিতি। বিপ্লবী কৃষকদের লৌহ দুর্গে পরিণত হয় নদীয়া-মুর্শিদাবাদ জেলা সীমান্ত
অঞ্চল। বহির্বঙ্গেও এর প্রভাব পড়ে। বিহারের মুঙ্গের ও ভাগলপুর এবং উত্তরপ্রদেশের
বালিয়া ও ভাদোহী জেলা বিপ্লবী কৃষকদের স্বতন্ত্র রিয়াসৎ রূপে পরিচিত হয়। গ্রামে
গ্রামে সমান্তরাল প্রশাসন চালায় বিপ্লবী কমিটি। খামার জমির পুনর্বন্টন, জমিদার-জোতদারদের
গোডাউনে জমে থাকা শস্য ও অন্যান্য সম্পত্তির বাজেয়াপ্তকরণ ও বণ্টন এবং শস্যাদির
দাম নির্ধারণ তৎকালীন পার্টি নেতৃত্বের উল্লেখযোগ্য কাজ।
বৎসরান্তে, দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয়
কেন্দ্রীয় অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক স্তরে সংগ্রামের বিকাশের কথা
উল্লেখ ক’রে জাতীয় স্তরে পার্টির কাজের মূল্যায়ন করা হয় ও ঘোষণা করা হয়— ‘আমাদের দেশেও
আমাদের পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত কৃষক সংগ্রামগুলো চিন বিপ্লবের পথেই নানান বাধা
বিপত্তি সত্ত্বেও অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছে। বিহারে, পশ্চিমবাংলায় গেরিলাযুদ্ধের
প্রাণবন্ত বিকাশ দুনিয়ার সাধারণ স্রোতকেই প্রতিফলিত করছে। কারো সাধ্য নেই এ পথ
থেকে ভারতীয় জনগণকে সরিয়ে আনে।’
১৯৮০’র প্রথমার্ধে শান্তি পাল গোষ্ঠী
থেকে ভেঙে আসা দক্ষিণবঙ্গ জোনাল কমিটির নেতা অমর ভট্টাচার্য পরিচালিত ‘আঞ্চলিক ব্যুরো’র (পরবর্তীকালে
কেন্দ্র সংগঠনী ব্যুরো) নদীয়া জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা রমেন সাহা ও তাঁর কমরেডরা
পার্টিতে যোগ দেয়। কৃষ্ণনগরের শক্তিনগর ব্লকের এক আমবাগানে ঐক্য মিটিং সম্পন্ন হয়
এবং ঐক্যপত্র স্বাক্ষরিত হয় রমেন সাহা ও আজিজুল হকের মধ্যে।
’৮০’র মাঝামাঝি
সময়ের কেন্দ্রীয় কমিটির এক মিটিং-এ ‘আঞ্চলিক বিপ্লবী সরকার ও নিয়মিত বাহিনী’ ঘোষণার প্রস্তাব
আনেন রঞ্জন। কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যান্য সদস্যরা এই প্রস্তাবে রাজী হন এবং
গ্রামভিত্তিক বিপ্লবী কমিটিগুলোর চেয়ারম্যানদের নিয়ে আঞ্চলিক বিপ্লবী সরকার গঠন
করেন। সেইসব গ্রামে যে গেরিলা স্কোয়াডগুলো ছিল সেগুলোর কম্যান্ডারদের নিয়ে
এলাকাভিত্তিক কম্যান্ডার নির্বাচন করা হয় (ফৌজি ড্রেস, ব্যাচ, ব্যানার ইত্যাদি সহ)। প্রতি এলাকায়
স্কোয়াড পিছু একজন ক’রে পলিটিকাল কমিশার নিয়োগ ক’রে এলাকা ভাগ ক’রে দেওয়া হয়। এলাকা কম্যান্ডারদের
থেকে আঞ্চলিক কম্যান্ডার নির্বাচন করা হয় ও এইভাবে একে একে ব্রিগেড, রেজিমেন্ট
ইত্যাদিতে কম্যান্ড ভাগ ক’রে দেওয়া হয়। উত্তরবঙ্গে গড়ে ওঠে ‘শ্যাম ব্রিগেড’, দক্ষিণবঙ্গে ‘শুভাশিস
ব্রিগেড’। আঞ্চলিক সরকার প্রধানদের ভেতর থেকে রাজ্য সরকার প্রধান ও আঞ্চলিক
কম্যান্ডারদের ভেতর থেকে রাজ্য সেনা প্রধান নির্বাচন করা হয়। এর পর রাজ্য সরকার
প্রধানদের থেকে কেন্দ্রীয় সরকার প্রধান ও রাজ্য সেনা প্রধানদের থেকে কেন্দ্রীয়
মিলিটারি কমিশন প্রধান নির্বাচন করা হয়। কেন্দ্রীয় গণমুক্তি বাহিনী প্রধানের তত্ত্বাবধানে
সেনাদের পত্রিকা ‘লাল ফৌজ’ (বাংলা ও হিন্দি) প্রকাশ করা হয় এবং পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে সামরিক স্কুল
প্রতিষ্ঠা ক’রে ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকার প্রধানের
তত্ত্বাবধানে দুই রাজ্যের সমস্ত আঞ্চলিক সরকার প্রধানদের নিয়ে বিপ্লবী সরকারের আইন
প্রণয়ন ক’রে ৬০দফা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। গণমুক্তি বাহিনী দিবসে বিপ্লবী সরকারের
চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন— ‘বিপ্লবী সরকার ও নিয়মিত বাহিনীর আবির্ভাব ঘটেছে, জনযুদ্ধকে আরও
তীব্রতর ক’রে তার ভিতকে শক্তিশালী করুন...। আজ ভারতবর্ষে দুই সরকার, দুই ব্যবস্থা, দুই বাহিনী
মুখোমুখি।’
পশ্চিমবাংলার মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, দিনাজপুর ও
উত্তর ২৪ পরগণায় এবং বিহারের মুঙ্গের ও ভাগলপুরে, বিপ্লবী সরকারের কর্মসূচী অনুযায়ী, ‘স্বাধীন
রাজত্বের এলাকা’-গুলোতে নিহত এবং পালিয়ে যাওয়া জোতদারদের জমি, খাসজমি, পতিত জমি ও অতিরিক্ত জমি দখল করা
শুরু হয়। এছাড়া গেরিলা অঞ্চলগুলোতেও চলে ফসল দখল। গণমুক্তি বাহিনীর তীক্ষ্ণ
প্রহরায় রাতের বেলা ধান কেটে নেওয়া হয়। শুধু নদীয়াতেই ১০,০০০ মন ধান দখল করা হয়। দখল করা
ফসলের অধিকাংশ কৃষকদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে ছোট একটা অংশ রেখে দেওয়া হয় গণবাহিনীর
সদস্যদের ভরণপোষণের জন্যে। কৃষ্ণনগরের কাছে অঞ্জনা নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে যে
সমস্ত ইটভাটা ছিল সেগুলোর জমি দখল ক’রে তাতে কৃষকদের বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়। বামফ্রন্ট
সরকারের পুলিশি ফতোয়াকে অগ্রাহ্য ক’রে নদীর চড় জমিতে শুরু হয় চাষাবাদ।
বিপ্লবী সরকারের এক ধারায় শ্রেণীশত্রুদের
নিরস্ত্র করার কথা বলা হয়। সেই অনুযায়ী সমস্ত জোতদার, জমিদারকে তাদের লাইসেন্সযুক্ত বা
বিহীন অস্ত্র বিপ্লবী কমিটির কাছে জমা দিতে বলা হয় (না দিলে, বিপ্লবী সরকারের
আইন মোতাবেক অঙ্গচ্ছেদ বা মুণ্ডচ্ছেদের সাজা হবে জানিয়ে দেওয়া হয়)। শতাধিক অস্ত্র
জমা পড়ে। একদিনে, শুধু দিনাজপুরেই জমা করা হয় ৭০টা বন্দুক। ছোট অস্ত্র (পিস্তল ও রিভলভার)
দিয়ে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্যদের সজ্জিত করা হয়।
হাটবাজার থেকে তোলা আদায় ও চাঁদার নামে
রাজনৈতিক দলগুলোর জুলুমবাজি নিষিদ্ধ করা হয় বিপ্লবী সরকারের এক ধারায়। এর ফলে ‘স্বাধীন
রাজত্বের এলাকা’-গুলোতে গ্রামীণ বদবাবু এবং গুণ্ডা-বদমায়েশদের দৌরাত্ব বন্ধ হয়ে যায়। এলাকার
জমিদার-জোতদারদের জন্য যে কর ধার্য করা হয় তার একাংশ দিয়ে পার্টির পক্ষ থেকে চারু
মজুমদার ও সরোজ দত্তর রচনাবলী প্রকাশ করা হয় বাংলায় ও হিন্দিতে। নদীয়া মুর্শিদাবাদ
আঞ্চলিক বিপ্লবী সরকারের উদ্যোগে শক্তিনগরে ‘শুভাশিস শিশু উদ্যান’ ও শুভাশিস শহীদ
বেদী প্রতিষ্ঠা করা হয়। তার সমস্ত হিসাবপত্র লিফলেট আকারে ছাপিয়ে জনগণের মধ্যে
বিলি করা হয়।
১৯৮১ সালের শুরুতে সি,পি,আই, (এম-এল) দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির
দক্ষিণবঙ্গ জোনাল কমিটির উদ্যোগে পার্টির দক্ষিণবঙ্গ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই
সম্মেলনে ‘কলকাতা শিল্পাঞ্চল কমিটি’র কমরেডরা পার্টিতে আসেন। শোনা যায়, এঁদের হাতেই খতম
হয় জাঁদরেল পুলিশ ইনস্পেক্টর তারাপদ বোস ওরফে টর্পেডো। সম্ভবত সরোজ দত্ত হত্যার
প্রতিশোধ হিসাবে তাকে খতম করা হয়। ২রা জুলাই, ১৯৮১ তারিখে শিলিগুড়ি শহরের ওপর দ্বিতীয়
কেন্দ্রীয় কমিটির গেরিলারা খতম করে অবিভক্ত সি,পি,আই, (এম-এল)-এর শেষ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য
সম্পাদক দীপক বিশ্বাসকে। চারু মজুমদারের শেল্টারের খবর পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছিলেন
তিনি, সম্ভবত এই ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ শাস্তি স্বরূপ তিনি খুন হন গেরিলাদের হাতে।
’৮২-র
বিধানসভা নির্বাচনের আগ দিয়ে দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির ‘নির্বাচন বয়কট’ স্লোগান
সম্পর্কে খবরের কাগজে সংবাদ প্রকাশ হতে থাকে। লিন পিয়াও-পন্থীরা যে সরকারী কাজে
ব্যাপক বাধা সৃষ্টি করতে পারে সেই নিয়ে বুর্জোয়া গণমাধ্যমগুলোতে খবর ছড়াতে শুরু
করে। ১৬ই মে, ১৯৮২, নির্বাচনের ঠিক দুদিন আগে এক আকস্মিক আক্রমণে সরকারপক্ষ হঠাৎ
দিশেহারা হয়ে যায়। দৈনিক ‘দ্যা স্টেটসম্যান’ খবর দেয়— জনতা পার্টির নেতা ও এম,এল,এ,
কাশীকান্ত মৈত্র এবং কৃষ্ণনগরের জনতা কংগ্রেস প্রার্থী গোপাল সরকারকে দ্বিতীয়
কেন্দ্রীয় কমিটির নদীয়া-মুর্শিদাবাদ আঞ্চলিক বিপ্লবী সরকার গ্রেপ্তার করেছে।
আকস্মিক আঘাতে জেরবার রাজ্য সরকার যতক্ষণে পুলিশ-আধামিলিটারি নামিয়ে নদীয়ার গ্রামে
গ্রামে হানা দিতে শুরু করে, ততক্ষণে বিপ্লবীরা পৌঁছে গেছেন বীরভূমে। শোনা যায়, অপহৃতদের
সেখানকার কোনও এক গ্রামীণ বাঙ্কারে রাখা হয়েছিল এবং সেখানেই তাঁদের বিচার হয়। ১৯
তারিখের ‘দ্যা স্টেটসম্যান’-এ খবর প্রকাশিত হয়— বিপ্লবী সরকারের পক্ষে জনতা নেতা
প্রফুল্ল সেনকে ফোন ক’রে জানানো হয়েছে রাজ্যের কারাগারে যে ৫০০ জন নকশাল বন্দী রয়েছেন তাঁদের
মুক্তি দিলে তবেই কাশিকান্ত মৈত্র সমেত বাকিদের ছাড়া হবে। নকশাল বন্দী থাকার কথা রাজ্য
সরকার প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার ক’রে লিস্ট চায়। আঞ্চলিক বিপ্লবী সরকারের
তরফে লিস্ট পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গণমাধ্যমগুলো এই খবর ব্যাপকভাবে প্রচার করে। নির্বাচন
পর্ব মিটে গেলে কাশীকান্ত বাবুদের কলকাতাগামী ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়।
দিনে দিনে লড়াইয়ের মাত্রা আরও জঙ্গি হয়ে ওঠে।
প্রাদেশিক নেতৃত্ব আঞ্চলিক কমিটিগুলোকে যুগপৎ আরও লড়াকু এবং আরও বেশী ক’রে চলমান যুদ্ধে
শামিল হতে বলেন। বাংলার কোর্চপুকুর ও পূর্বস্থলীতে এবং বিহারের ভাগলপুরে তিনটে
রাইফেল অ্যাকশন সংঘটিত হয়। পাশাপাশি বিপ্লবী কমিটিগুলোর নেতৃত্বে গণ কার্যকলাপও
চলতে থাকে।
বিপর্যয়
এমন আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ সাধারণ মানুষের
কাছে দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়। নতুন নতুন অনেক যোগাযোগ
আসতে থাকে, এমনকি বাবা-মা’রা ছেলেদের বিপ্লবী কমিটির হাতে তুলে দিতে আরম্ভ করেন তাদের বিপ্লবী যোদ্ধা
বানাবার আশায়। গণভিত্তি এভাবে বেড়ে উঠতে দেখে নেতৃত্বের মনে প্রবল আশার সঞ্চার হয়
এবং উত্তর বাংলায় বেশ কিছু আঞ্চলিক কমিটিকে তাঁরা বেপরোয়া অ্যাকশনের পথে চালিত
করেন। শত্রুও সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সংগ্রামী এলাকাগুলোর ওপর। ঘেরাও-দমন
অভিযানের সামনে পড়েন গেরিলা যোদ্ধারা। চলাচলের ক্ষমতা (মোবিলিটি) কমতে থাকে তাঁদের, ধরপাকড় শুরু হয়
জোরকদমে। কিছু জায়গায় পালটা প্রতিরোধও হয়। কিন্তু একটানা রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে
লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। সর্বক্ষণের কর্মী সংখ্যা এক ধাক্কায় কিছুটা কমে
আসে।
সেটব্যাকের এই মুহূর্তে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির
মিটিং বসে তিস্তার চর সংলগ্ন এলাকায়। সেখানে, নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে, বাম বিচ্যুতির
শিকার হওয়ার অভিযোগ এনে আজিজুল হককে তুলোধোনা করেন কেন্দ্রীয় কমিটির তিন সদস্য
সুনীল, সুজিত এবং রঞ্জন। পুলিশি ধরপাকড় বেড়ে যাওয়ায়, নিরাপত্তার কারণে এই মিটিং শেষ হয়
না। কিছু দিন পর বিহারের ছাপরা জেলার এক গ্রামে পূর্ব বিহার জোনাল কমিটির মিটিং
বসে। সেখানে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। উক্ত জোনাল কমিটির
সম্পাদক রঞ্জনকে সামনে রেখে বিহার রাজ্য কমিটির সম্পাদক সুনীল এবং উত্তরবঙ্গ জোনাল
কমিটির সম্পাদক সুজিত কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক নিশীথ ভট্টাচার্য এবং পশ্চিমবঙ্গ
রাজ্য সম্পাদক আজিজুল হকের বিরুদ্ধে মিটিং-এর ভেতরেই সমালোচনা তুলতে থাকেন। জোনাল
কমিটির মিটিং-এ এ বিষয়ে কোনও কথা বলা কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক বা অন্য রাজ্যের
দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতৃত্বের পার্টি গঠনতন্ত্রের বিরোধী হওয়ায় অভিযুক্ত কমরেড দুজন
চুপ থাকেন। তিক্ততা এতদূর গড়ায় যে নিশীথ ভট্টাচার্যের তৈরি করা প্রায় একশ
পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রস্তাব কেন্দ্রীয় কমিটির ইংরাজি মুখপত্র ‘লিবারেশন’-এ ছাপা হয় না।
এর পর পশ্চিম বিহারের সিওয়ান জেলার সাতোয়াঁরা গ্রামে কেন্দ্রীয় কমিটির অধিবেশন হয়।
সেখানে ‘চলমান যুদ্ধের’ বিষয়কে সামনে রেখে আজিজুল হক এবং নিশীথ ভট্টাচার্যের বিধ্বংসী সমালোচনা
করেন বাকিরা। সেই মিটিং-এ সমস্ত দায়দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিশীথ ভট্টাচার্য
সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দেন। মিটিং শেষে কেন্দ্রীয় কমিটির সব সদস্য নিজের
নিজের মত বেরিয়ে যান, পথে ৫ জন নিরাপত্তারক্ষীসহ গ্রেপ্তার হন নিশীথ ভট্টাচার্য। এর অনতিকাল পরেই
কেন্দ্রীয় টেকনিক্যাল টিমের ইনচার্জ ও দক্ষিণবঙ্গ জোনাল কমিটির সম্পাদক তাপস সরকার
পুলিশের জালে আটকা পড়েন। শোনা যায়, তাপস সরকার রাজসাক্ষী হয়েছিলেন। এর কিছুদিন পর সোদপুর
অঞ্চল থেকে গ্রেপ্তার হন আজিজুল হক।
রাষ্ট্রের হিংস্র আক্রমণ থেকে কর্মী এবং
সমর্থকদের বাঁচাতে, পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর ঘেরাও-দমন ওঠাতে আজিজুল হক সাময়িক যুদ্ধবিরতি
ঘোষণা করেন। কথামত পার্টির মহিলা সদস্য ও সমর্থকদের মুক্তি দেয় পুলিশ। ঘেরাও-দমনও
অনেকটা শিথিল ক’রে দেওয়া হয়। কিন্তু এই সুযোগকে নতুন ক’রে সংগঠন গড়ার কাজে না লাগিয়ে
বাইরের কেন্দ্রীয় কমিটির তিন সদস্য সুনীল, রঞ্জন এবং সুজিত পার্টির
অভ্যন্তরে রটাতে থাকেন যে আজিজুল হক এবং নিশীথ ভট্টাচার্য ধরা পড়ার পর আত্মসমর্পণ
করেছেন। যুদ্ধবিরতি মানে যে যুদ্ধের শেষ নয়, সামান্য হাঁপ নেবার অবকাশ মাত্র –এটাই
তাঁরা অস্বীকার করেন ও অগণতান্ত্রিকভাবে আজিজুল হক ও নিশীথ ভট্টাচার্যকে বহিষ্কার
করেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ভাঙনকাল : লিন পিয়াও-পন্থী আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়
অতীতের মূল্যায়ন
নিশীথ ভট্টাচার্যের বহিষ্কারের পর এক আপৎকালীন
অধিবেশনের ভেতর দিয়ে সুনীল ব্যানার্জী কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক হন। ক্ষমতায় এসেই
তিনি বিপ্লবী সরকারের আমলের যাবতীয় ঘোষণা— ‘স্বাধীন রাজত্বের এলাকা’, ‘নিয়মিত বাহিনী’, ‘ব্রিগেড’ ইত্যাদিকে বাম
বিচ্যুতি হিসাবে চিহ্নিত করেন। ’৭২ থেকে ’৮২, —এই দশ বছরের সংগ্রামের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রথমে মহাদেব
মুখার্জীর আমলে এবং পরে নিশীথ ভট্টাচার্য ও আজিজুল হকের জামানায় পার্টি যে সমস্ত
ভুল করেছে সেগুলো আসলে বামপন্থী সুবিধাবাদের দৃষ্টান্ত। মহাদেব মুখার্জী সম্পর্কে
অবশ্য সুনীল কিছুটা হলেও নমনীয়তার পরিচয় দেন এই বলে যে তিনি চারু মজুমদার ও লিন
পিয়াও-এর গুরুত্বকে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। সেদিক থেকে নিশীথ ভট্টাচার্য ও আজিজুল হক
সম্পর্কে তাঁর আক্রমণ ছিল নির্মম।
অতীতের সমস্ত সাফল্য কলমের এক খোঁচায় এভাবে
নস্যাৎ করায় কেন্দ্রে নতুন বিতর্ক দেখা দেয়। রঞ্জন পালটা দলিল পেশ করেন, সেখানে সুনীলের
দৃষ্টিভঙ্গি পলায়নবাদের অভিপ্রকাশ বলে নিন্দিত হয়। পার্টিতে অবশ্য থাকা হয় না
রঞ্জনের। উপদলীয় চক্রান্তে অস্থির হয়ে ১৯৮৩ সালে প্রশাসনের কাছে তিনি আত্মসমর্পণ
করেন। ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসারের চাকরিও তিনি ফিরে পান যা তিনি রাজনৈতিক জীবনের
শুরুতে ছেড়ে এসেছিলেন।
কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য দুই সদস্য সুজিত এবং
তরুণ (ওরফে জীবন চক্রবর্তী) সুনীলের মূল্যায়নের সাথে একমত ছিলেন না। তাঁদের
বক্তব্য— মহাদেব মুখার্জী থেকে নিশীথ ভট্টাচার্য, দুজনের আমলেই নেতৃত্ব ছিল মূলত ‘ধূর্ত’ সংশোধনবাদীদের
হাতে যাঁরা অতি সুকৌশলে, বাম খোলসের আড়ালে পার্টিকে দক্ষিণ সংস্কারবাদ ও
সংশোধনবাদের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল।
নতুন পথ
১৯৮৩-র ডিসেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় কমিটি
শুদ্ধিকরণ আন্দোলনের ডাক দেয়, উদ্দেশ্য— গোঁড়ামিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদকে নির্মূল করা। কিন্তু
বিড়ম্বনার কথা এই, উপদলীয় কর্মকাণ্ড এবং ক্যাডারদের ওপর নেতৃত্বের চাপিয়ে দেওয়া ফতোয়া গোটা
প্রক্রিয়াটাকেই বানচাল ক’রে দেয়। যে অভিযান এক স্বাস্থ্যকর উদ্দেশ্য নিয়ে আরম্ভ
হয়েছিল তার পরিণতি ঘটে অরাজনৈতিক ব্যক্তি কুৎসার চালাচালি দিয়ে। স্বাভাবিকভাবে
সংগঠনে তার প্রভাব পড়ে, পার্টির আঘাত হানার ক্ষমতা তলানিতে এসে ঠেকে।
সাংগঠনিক সংকট কাটাতে ’৮৫-র ৩০এ
জানুয়ারি কেন্দ্রীয় কমিটির বিশেষ সভা বসে। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয়—(১) সি,পি,আই, (এম-এল) থেকে
উদ্ভূত যে সমস্ত গোষ্ঠী সশস্ত্র সংগ্রামে লেগে আছে তাদের এক পার্টি শক্তি হিসাবে
বিচার করতে হবে; (২) সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে একটা পত্রিকা প্রকাশ ক’রে সেটাকে প্ল্যাটফর্ম হিসাবে
ব্যবহার ক’রে বিপ্লবী ঐক্যের চেষ্টা করতে হবে; (৩) শ্রেণী সংগ্রামের বিভিন্ন
ধরনের সমন্বয় ঘটাতে হবে। ‘নতুন বছরের দাবী—পার্টি সংগঠনকে শক্তিশালী করুন, সর্বভারতীয়
স্তরে সম্প্রসারিত করুন’ এবং ‘শহরাঞ্চলে আজকে পার্টির কাজ সম্পর্কে’ শীর্ষক দুটো
প্রস্তাব পাশ করা হয় এই মিটিং-ও। দলিল দুটোতে আইনি ও বেআইনি সংগ্রামের সমন্বয়
সাধনের কথা বলা হয়, দেওয়া হয় উপরোক্ত পয়েন্টগুলোর ব্যাখ্যা। ঐ বছরের জুলাই মাসে বিহার রাজ্য
কমিটির বৈঠকে সুনীল এক ভাষণ দেন যাতে আইনি গণসংগঠন গড়া ও আইনি ধাঁচে গণআন্দোলনের
গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়।
বস্তুতঃ, সুনীল যে লাইন হাজির করেন তা ছিল
আংশিকভাবে আজিজুল হকের চিন্তা প্রসূত। কিন্তু আজিজুল হক শুধু আইনি গণসংগঠন বা আইনি
সীমার মধ্যে থেকেই গণআন্দোলন করতে চান নি। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক গণআন্দোলনের রূপ
যা ক্রমে উচ্চতর সংগ্রামে বিকশিত হবে এবং সশস্ত্র কৃষক যুদ্ধের সেবা করবে। এলাকায়
এলাকায় কৃষক সমিতি তৈরি, ই,এফ,আর, হামলার মুখে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে গণ ধর্ণা, সাধারণ পুলিশকে
খতম না ক’রে তার রাইফেল দখল ইত্যাদি ছিল আসলে গণসংগঠন কর্তৃক গণআন্দোলন গড়ে তুলে
উচ্চতর সংগ্রামের অভিমুখে যাত্রা করার ভ্রূণরূপ মাত্র। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির
বাকি সদস্যরা এই লাইন মানতে পারেন নি, নিশীথ ভট্টাচার্য ঘোষণা করেছিলেন, প্রয়োজনে তাঁরা
বন্দুকের নল দিয়ে গণলাইন চালাবেন।
পার্টির মধ্যে চিড়
নানান সমস্যায় জেরবার সংগঠনে নতুন আশার আলো
বয়ে আনে ১৯৮৫-র জেলব্রেক। রাজ্য প্রশাসনকে হতচকিত ক’রে ছ’জন বিপ্লবী—অজিত চক্রবর্তী
(ওরফে অংশু, ট্যাঁরা মাস্টার), সুনীল দাস, সুনীল বর্মণ, কামিনী বর্মণ, ননীগোপাল বর্মণ এবং পরেশ বর্মণ কোচবিহার জেলের প্রাচীর
টপকে পালিয়ে যান।
এরকম দুঃসাহসিক কাজে স্নায়ু চাঙ্গা রাখার জন্য
পার্টি নেতৃত্ব কমরেডদের প্রশংসা করেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির ইংরাজি মুখপত্র ‘লিবারেশন’-এ এর বিস্তারিত
রিপোর্ট উপস্থিত করেন না। সুজিত এই নিয়ে পার্টির ভেতরে তোলপাড় শুরু করেন। পার্টি
সম্পাদক যে নিজের ‘মধ্যপন্থী’ লাইন চালাবার উদ্দেশ্যেই এই ‘চক্রান্ত’ করেছেন এ কথা বার বার তিনি নানাভাবে প্রচার করতে থাকেন।
এর আগে, ‘দেশব্রতী’র এপ্রিল-মে-জুন’ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে শ্বেত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লাল
সন্ত্রাস গড়ে তোলার ডাক দিয়ে তিনি ঘুড়িয়ে কেন্দ্রীয় লাইনের বিরোধিতা করেছিলেন, এমন কি তা সুনীল
তথা কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ সদস্যের দ্বারা নিন্দিতও হয়েছিল। কিন্তু তাতেও
সুজিতকে থামানো যায় নি।
ক্রমে এই তর্ক-বিতর্ক দুলাইনের সংগ্রামের
নির্দিষ্ট রূপ ধারণ করেছিল। ৩০।১০।৮৫ তারিখে সুজিত ও তরুণ কেন্দ্রীয় কমিটিতে ‘তত্ত্বে ও
প্রয়োগে বিলোপবাদকে চূর্ণ করুন, শ্রদ্ধেয় নেতার বিপ্লবী লাইনের লালঝাণ্ডাকে ঊর্ধ্বে তুলে
ধরুন’ শীর্ষক দলিল পেশ করেন। দলিলে বলা হয়— রাষ্ট্র যখন তার আক্রমণে উত্তুঙ্গ
তখন কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক ও কেন্দ্রের অধিকাংশ কমরেড ভীরু ভদ্রলোকের মতো
আত্মসমর্পণবাদী পথ গ্রহণ ক’রে আইনানুগ মরীচিকার সামনে নতজানু হয়ে পড়েছে ও পার্টিকে
বিলুপ্ত ক’রে দেবার কাজে নেমেছে। কেন্দ্রীয় কমিটি পালটা দলিল দিয়ে সুজিত ও তরুণের
দলিলের দাবিগুলোকে নস্যাৎ করলেও সুজিত অতি দ্রুত আর একটা দলিল পেশ করেন এবং
পশ্চিমবাংলা রাজ্য কমিটির কমরেডদের কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করেন। সুস্থ
বিতর্কের অবকাশ কমে আসার ফলে কেন্দ্রীয় কমিটি সুজিতকে বহিষ্কার করে, কিন্তু তাঁর
ধূর্ত রাজনৈতিক অসিচালনায় বাংলা রাজ্য কমিটির মূল অংশটাই সুজিতের সাথে চলে আসে।
সুজিতগোষ্ঠীর অপসারণের পর বাংলার নদীয়ায় আবার
নতুন ক’রে শুরু হয় সংগ্রাম। ২০শে সেপ্টেম্বর রানাঘাট মহকুমার অন্তর্গত এক গ্রামে
স্থানীয় বিপ্লবী কমিটি ও গণফৌজের স্থানীয় গেরিলা বাহিনীর প্রহরায় ৬৮ বিঘা জমি দখল ক’রে ৪২ জন
ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়। তাহেরপুরেও জমি দখলের আন্দোলন সংঘটিত হয়।
উত্তরপ্রদেশের বালিয়াতে আন্দোলন গড়ে ওঠে জমির দাবিতে। সেখানে কৃষক গেরিলারা ভগবান
সিং নামে এক জোতদারকে ঘরোয়া অস্ত্র দিয়ে খতম করেন। বিহারের বাঁকা, বৈশালী, মুঙ্গের এবং
ভাগলপুরে ফসল দখলের সংগ্রাম বহু মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। বৈশালীতে বিনোদ মিশ্রর
লিবারেশন গোষ্ঠীর বেশিরভাগ কর্মী যোগ দেন দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটিতে। তাঁদের হাতে
জখম হয় জেলার দুই বাহুবলি নেতা বৈদ্যনাথ রায় ও রাজবল্লভ রায়। জেলা কংগ্রেস
(ইন্দিরা)-র নেতা ও জোতদার সুরেন্দ্র প্রসাদ সিংহকে খতম করে পার্টির গেরিলা
স্কোয়াড। তার পুকুর ও ধানিজমি দখল করা হয় এবং চাষাবাদের জন্য কৃষকদের হাতে তুলে
দেওয়া হয়।
সুজিতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হলে সুনীল মূলত
বিহার ও উত্তরপ্রদেশের কমরেডদের নিয়ে পার্টির শক্তি ফেরাতে চেষ্টা করেন।
পশ্চিমবঙ্গে মুষ্টিমেয় কিছু কর্মী, যাঁরা কেন্দ্রের প্রতি অনুগত ছিলেন, তাঁদের নিয়ে
তিনি গড়ে তোলেন রাজ্য সংগঠনী কমিটি। ১লা থেকে ৩রা অক্টোবর (’৮৬) বাংলা, বিহার ও
উত্তরপ্রদেশের নেতৃস্থানীয় পার্টি-কর্মীদের বিশেষ সম্মেলনে এক সাধারণ প্রস্তাব
গ্রহণ করা হয় এবং পার্টি ঐক্য সম্পর্কে গৃহীত হয় বিশেষ প্রস্তাব।
এই ঐক্য প্রস্তাবের আলোকেই ২০০৩ সালে দ্বিতীয়
কেন্দ্রীয় কমিটির এই অংশ মাওবাদী কম্যুনিস্ট কেন্দ্রের সাথে জুড়ে যায়। সংযুক্তি
প্রক্রিয়া জারি রাখতে লিন পিয়াও-পন্থী অবস্থান থেকেও সরে আসেন সুনীল। পড়ে এম,সি,সি, সি,পি,আই, (এম-এল) পিপলস
ওয়ার-এ মিলে গেলে সুনীল ও তাঁর কমরেডরা সি,পি,আই, (মাওবাদী) গঠনের অন্যতম অংশীদার
হয়ে ওঠেন। কিন্তু বেশী দিনের জন্য নয়, পার্টির ভেতরে আবারও লিন পিয়াও-কে নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা
দেয় এবং সুনীল ও তাঁর অনুগামীদের বহিষ্কার করা হয় বলে শোনা যায়।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বিলুপ্তি : লিন পিয়াও-পন্থী আন্দোলনের ‘শেষ’ পর্যায়
ব্ল্যাঙ্কিবাদের বর্বরতা
১০ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭ সুজিত তাঁর কেন্দ্র
পুনর্গঠিত করেন। ঐ বছরের ৪ঠা নভেম্বর দমদম জেলের গারদ ভেঙে বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ও
গৌতম চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ছ’জন বিপ্লবী—সুকুমার দুর্লভ, কালিমোহন পাল, সুজিত মণ্ডল, রতন দাস, বিষ্টু সর্দার ও
বাসুদেব দে পালিয়ে আসেন। এই সাফল্যে সুজিত আত্মহারা হন। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি
বিচার না করেই ‘শ্বেত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লাল সন্ত্রাস’ ছড়ানোর ডাক দেন। নিশীথ
ভট্টাচার্যের আমলে দিনাজপুরের সংগ্রামের উদাহরণ টেনে ‘উচ্চ মাত্রার দিনাজপুর’ তৈরির হুকুমও
জারি করেন। তাঁর নজর এড়িয়ে যায় যে, ’৮৭-র পশ্চিমবঙ্গ এবং ’৮০-’৮২-র পশ্চিমবঙ্গ এক নয়। ততদিনে
বামফ্রন্ট তথা সি,পি,আই, (এম) বাংলার গ্রামাঞ্চলে অপারেশন বর্গা ও পঞ্চায়েতি রাজ মারফৎ তার
রাজনৈতিক-সামাজিক ভিত মজবুত করেছে, আধাসামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর ভেতর পুঁজিবাদী ঝোঁক ফুটে
উঠেছে—জন্ম হয়েছে অবক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক ছোপ লাগা এক বিচিত্র পচাগলা
পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার। এছাড়াও তখন গ্রামাঞ্চলের মূল সামন্ততান্ত্রিক ভিত্তি
হয়ে দাঁড়িয়েছে পঞ্চায়েতের ধূর্ত গহনচারী পথ—এমন এক ব্যবস্থা যাকে শুধু
তথাকথিত খতমের লড়াই দিয়ে পরাজিত করা যায় না। তাছাড়া, সুজিতের বিবেচনাতে এও আসে নি যে, ’৮২র বিপর্যয় ও ’৮৬র ভাঙন
ইতিমধ্যেই সংগঠনের শক্তি নাশ করেছে, গণভিত্তিকেও ক’রে এনেছে সঙ্কুচিত।
পার্টির নেতা-কর্মীরা অবশ্য সুজিতের এই আত্মভাবি
মূল্যায়নের সামান্যতম প্রতিবাদ করেন নি। তাঁরা একেবারে অনুগত সৈনিকের মতোই
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতিটা নির্দেশ কাজে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিছু
জায়গায় রাইফেল দখল ও খতম হয়েছিল। কিন্তু তার মূল্য দিতে হয়েছিল অসীম। রাইফেল দখলের
জবাবে পুলিশ দুজন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বাসুদেব দে এবং দুলাল দাস মোহান্তকে তুলে
নিয়ে গিয়ে খুন করে। ৮জন সাধারণ পার্টি সদস্যও খুন হন পুলিশের হাতে। ঘেরাও-দমনের
চাপে জেলা ও মহকুমা কমিটিগুলো ভেঙে যেতে থাকে। ভাঙা সংগঠন আরও ভেঙে যায়।
নমনীয় রণকৌশল
এ হেন সংকটে, পার্টির অবস্থা ফেরাতে সুজিত এক ‘নতুন’ লাইন আমদানি
করেন—যার আনুষ্ঠানিক নাম ‘নমনীয় রণকৌশল’। বলা চলে, সুনীলের আমলে আইনি গণসংগঠন, গণআন্দোলনের যে লাইন ছিল, সুজিতও সেই একই
লাইন উপস্থিত করেন, যদিও নতুন বাগভঙ্গির কারিকুরি সহযোগে। তৈরি হয় গণসংগ্রাম কমিটি, বিপ্লবী কৃষক
ফ্রন্ট (বি,কে,এফ,), ছাত্র-যুব সংগ্রাম কমিটি (সি,ওয়াই,এস,সি,), মাও চিন্তাধারা প্রচার টিম, বিপ্লবী সাংস্কৃতিক সেল (আর,সি,সি,)। —এগুলো বাংলায়।
উত্তরপ্রদেশের ভাদোহী, বালিয়া এবং বেনারসে গড়ে ওঠে কিষাণ-মজদুর মুক্তি মোর্চা (কে,এম,এম,এম,), চেতনা
সাংস্কৃতিক মঞ্চ (সি,এস,এম,) এবং কার্পেট শ্রমিকদের সংগঠন কালিন মজদুর মুক্তি মোর্চা।
গোড়ার দিকে কৃষক ও ছাত্রদের ভেতর এই লাইন ভালো
সাড়া পায়। বি,কে,এফ, কিছু গুরুত্বপূর্ণ কৃষক আন্দোলন পরিচালনা করে, বেশ কিছু খাস জমি দখল করে
উত্তরবঙ্গের নানান জায়গায়। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও দিনাজপুর জেলায় এবং উত্তরপ্রদেশের
বালিয়ায় পুলিশ বাহিনী এবং মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বিপ্লবী কৃষকদের লড়াই
হয়, কিন্তু
রাষ্ট্রযন্ত্রের লাগাতার আক্রমণে কৃষক প্রতিরোধের পাঁজর শেষ পর্যন্ত গুঁড়িয়ে যায়।
গ্রেপ্তার হন বহু সক্রিয় কর্মী। ১৫ই নভেম্বর ১৯৯৪-এ জলপাইগুড়ির বগরিবাড়িতে সি,পি,আই, (এম) ক্যাডারদের
হাতে রাজীব রায় ও ননীগোপাল রায় নিহত হন। বি,কে,এফ, এবং পার্টির একজন উঁচু স্তরের
নেতা ছিলেন রাজীব।
ক্ষয় ও বিলুপ্তি
৪ঠা জানুয়ারি, ১৯৯৭। রাজনৈতিক গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে
জড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির নাম। খুন হন কানু সান্যালের সি,ও,আই, (এম-এল) দলের
সদস্য ও প্রাক্তন দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি কর্মী জীবন চক্রবর্তী। হত্যার পেছনে
প্রধান সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসাবে পুলিশ গ্রেপ্তার করে বি,কে,এফ,-এর সম্পাদক পূর্ণেন্দু সরকারকে।
অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় অবশ্য পরে তিনি খালাস পেয়ে যান। ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯-এর মাঝ অবধি
দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির গেরিলাদের হাতে কিছু সংখ্যক ছোট জোতদার খতম হয়। দুই
দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি ও মুর্শিদাবাদে কয়েকজন সরকারী বড় কর্তাও নিহত হয় তাঁদের হাতে। এর
জবাবে সি,পি,আই, (এম) ক্যাডাররা কোচবিহার আঞ্চলিক কমিটির নেতা ও ভাওয়াইয়া গায়ক কামিনী বর্মণ, ইটাহারের বি,কে,এফ, সদস্য জিতেন শীল, তাঁর ৪ বছরের
শিশু পুত্র সাধন শীল, ১৬ বছরের তরুণ পার্টি সমর্থক সুজিত বর্মণ এবং বি,কে,এফ, ক্যাডার ঝাপনা পালকে হত্যা করে।
এসব ক্ষয়ক্ষতি বাদে আন্তঃপার্টি সমস্যাতেও
জেরবার হয় দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক অংশু সুজিতের
কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেন ও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি ধ্বংস
করার জন্য তাঁকে দায়ী করেন। জলপাইগুড়ি আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক শুভ কৃষক জনগণ ও
পার্টি কর্মীদের ব্যক্তিগত কাজে নিয়োগ করার অভিযোগে সুজিতকে অভিযুক্ত করেন।
সহিষ্ণুতার সাথে বিতর্ক মীমাংসা করার বদলে সুজিত
কড়া ব্যবস্থা নেন—বিদ্রোহী সদস্যদের পার্টি থেকে বহিষ্কার করেন। অংশু, শুভ এবং
তাঁদের সমর্থকরা এক কো-অর্ডিনেটিং কমিটি গঠন করেন এবং অনতিকাল পরেই নিজেদের লিন
পিয়াও-পন্থী অবস্থান পরিত্যাগ ক’রে সি,পি,আই, (মাওবাদী)-এর সঙ্গে শামিল হন। দ্বিতীয়
কেন্দ্রীয় কমিটির আর একটা টুকরো সি,পি,আই, (এম-এল) নকশালবাড়ির সাথে যুক্ত হয়ে যায়।
ডিসেম্বর ২৩, ২০০০, সংগঠন যখন একেবারেই ভেঙে
পড়েছে, পাঁচ জন সি,ওয়াই,এস,সি, প্রচারকারী এবং বি,কে,এফ, নেতা ডুলু দেববর্মা
বি,কে,এফ,-এর তৃতীয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলন আরম্ভ হওয়ার মুখেমুখে ডাকাতির
অভিযোগে কালিয়াগঞ্জ থানার ফতেপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন। অধিকন্ত, ১৩ই
সেপ্টেম্বর, ২০০৩-এ বালুরঘাট থানার পুলিশ শহরের এক হোটেলে হানা দিয়ে ৮০জন
সি,ওয়াই,এস,সি, স্বক্রিয় কর্মীকে অ্যারেস্ট করে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে
লিপ্ত থাকার অভিযোগ রুজু করা হয় তাঁদের নামে। গণসংগঠনগুলোকে আশ্রয় ক’রে পার্টির যে
ক্ষীণ রেখাটুকু ছিল তাও ক্রমশ অদৃশ্য হতে থাকে।
উপসংহার
লিন পিয়াও-পন্থীদের এই পরিণতিই কি হওয়ার ছিল?
লিন পিয়াও ও চারু মজুমদারের প্রতি একনিষ্ঠ থাকার কারণেই কি এমন হ’ল? অধিকাংশ
ক্ষেত্রে দেখা যায় এই অতিসরলীকরণকে আশ্রয় করেই লিন পিয়াও-বিরোধীরা তাঁদের বক্তব্য
শানান। তাঁরা গোল গোল করে, পল্লবগ্রাহী ঢঙে যুক্তি সাজান। কিন্তু তাতে সংগ্রামের
ঘনিষ্ঠ বিশ্লেষণ হয় না, বিপ্লবী সংগ্রামের প্রতিও সৎ থাকা যায় না।
প্রথম পর্যায়ের সংগ্রাম পর্যালোচনা করলে
স্পষ্টতই দেখা যাবে যে তৎকালীন পার্টি সম্পাদক ও তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা নেতৃত্ব চারু
মজুমদার ও লিন পিয়াও-বিরোধী সংগ্রামে দুই নেতার রাজনৈতিক গুরুত্বকে তুলে ধরার
পরিবর্তে যা তুলে ধরেছিলেন তার আদতে কোনও সুদূরপ্রসারী মতাদর্শগত দিশা ছিল না। এই
মতাদর্শহীন, ব্যক্তিবাদী রাজনীতি সেদিন এসে উপস্থিত হয়েছিল কারণ তাঁদের
প্রতিদ্বন্দ্বীরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও চিন্তার নামে ব্যক্তি কুৎসার পথ বেঁছে
নিয়েছিলেন। একদিকে, চারু মজুমদারের বিভিন্ন রচনা থেকে খাবলা খাবলা কিছু কথা তুলে
তাঁরা তাঁকে বাম সুবিধাবাদী বানিয়ে ব্যর্থতার সব দায় নিজেদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলেছিলেন।
অন্যদিকে, চিন পার্টির প্রতি অন্ধ আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ দশম কংগ্রেসের
রিপোর্টের রাজনৈতিক মর্মবস্তুকে উপেক্ষা করেছিলেন। লিন পিয়াওকে হেয় করার ক্ষেত্রে তাঁদের
যুক্তি ছিল বেশ অদ্ভুত। তাঁর একটা লেখারও সমালোচনা লিন-বিরোধীরা ক’রে উঠতে পারেন
নি। দশম কংগ্রেসের ব্যক্তি কুৎসাকে সম্বল ক’রে তাঁরা বলেছিলেন মাও-এর লেখা
লিন আত্মসাৎ করেছেন। এহেন অরাজনৈতিক কুৎসার জবাবে এই পর্যায়ে লিন পিয়াও-পন্থিরাও
তাই রাজনীতির ঊর্ধ্বে ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিছু ক্ষেত্রে
দায়িত্বজ্ঞানহীন চিহ্নিতকরণও ঘটেছিল তাঁদের তরফে। চারু মজুমদার ও লিন পিয়াও-এর
রাজনৈতিক বোধের প্রতি তাঁরা যদি একটু দৃষ্টি দিতেন তাহলে আর যাই হোক, ’৭৫ সালের
মধ্যে হাজার হাজার মুক্তাঞ্চল গড়ার অলীক, অতিবাম স্লোগান দেওয়া হত না।
দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ ’৭৮ থেকে ’৮২-র মধ্যে লিন
পিয়াও-পন্থীরা তত্ত্বে (কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও) এবং প্রয়োগে (তা যত ছোট আকারে
হোক না কেন) প্রমাণ করতে পেরেছিলেন যে চারু মজুমদার ও লিন পিয়াও
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও সেতুং চিন্তাধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পতাকাবাহী সৈনিক। তাঁরা
দেখিয়েছিলেন, কৃষক আন্দোলন সরাসরি ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম হিসাবেই হোক বা বিপ্লবী প্রতিরোধের
পথেই হোক, খতমের রূপ পরিগ্রহ করবেই। প্রান্তিক মানুষ সেদিন রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বাদ
পেয়েছিলেন, শোষণমুক্ত জনতার রাজ যে একটা বাস্তব সম্ভাবনা তা তাঁরা উপলব্ধি করতে
পেরেছিলেন। পার্টি নেতৃত্বের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও সেতুং চিন্তাধারা এবং লিন
পিয়াও-এর সর্বহারা রাজনৈতিক লাইন ও চারু মজুমদারের রাজনীতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকার
কারণেই এটা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্তরে পাতি বুর্জোয়া উপদলবাদের আধিক্য,
গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতির প্রতি এক প্রকারের অনীহা, কিছু ক্ষেত্রে বন্দুক
দিয়ে গণলাইন চালানোর মানসিকতা সংগঠনের অগ্রগতি রোধ করেছিল। যুদ্ধে যে কখনও কখনও
‘রিট্রিট’ করারও প্রয়োজন হয়, এটাও তাঁরা বিস্মৃত হয়েছিলেন।
তৃতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৬-র ভেতর আমরা
দেখতে পাই পূর্বতন নেতৃত্বের সংগ্রামী ফসলগুলোকে অস্বীকার করার মানসিকতা, যা আদতে
পাতিবুর্জোয়া ব্যক্তিবাদের পরিণাম। কিন্তু সেদিন সুনীল সশস্ত্র সংগ্রামের সহায়ক
রূপ হিসাবে গণসংগঠন গড়ার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা ছিল সময়ের দাবী। তার বিরোধিতা ক’রে সুজিত বা
তরুণ নারোদবাদী পথেরই পথিক হয়েছিলেন।
একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, সুজিতের লাল
সন্ত্রাস তৈরির লাইন এবং মহাদেব মুখার্জীর ’৭৫-এর ভেতর হাজার হাজার মুক্তাঞ্চল
তৈরির ডাক আদতে একই বাম হঠকারী চিন্তার ফসল। লেনিন একবার লিখেছিলেন, ‘During the revolution we learned to “speak French”, i.
e., to introduce into the movement the greatest number of rousing slogans, to
raise the energy of the direct struggle of the masses and extend its scope.
Now, in this time of stagnation, reaction and disintegration, we must learn to “speak German”, i.
e., to work slowly (there is nothing else for it, until things revive),
systematically, steadily, advancing
step by step, winning inch by inch. Whoever finds this work tedious, whoever
does not understand the need for preserving and developing the revolutionary
principles of Social-Democratic tactics in this phase too, on this bend of the
road, is taking the name of Marxist in vain.’ সুজিত ভেবেছিলেন সর্বদাই
তিনি ‘ফরাসী ভাষায়’ কথা বলার সুযোগ পাবেন, বিপ্লবী পরিস্থিতি থাকলেই সংগ্রামে
জোয়ার থাকবে। তিনি বিস্মৃত হয়েছিলেন চারু মজুমদারের শিক্ষা— ভারতবর্ষ অসম বিকাশের দেশ।
বিপ্লবী
পরিস্থিতি, জোয়ার, ভাঁটা, সংকট ইত্যাদি নিয়ে একটু আলোচনার দরকার আছে এক্ষেত্রে।
চিনা পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসে বিতর্ক ছিল বিপ্লবী সংকট নিয়ে। স্তালিন-এর কাছে এই
প্রশ্ন নিয়ে গেলে তিনি বলেন— ‘বিপ্লবে জোয়ার নেই, চলছে ভাঁটার টান।’ লি লিসান
প্রতিবাদ করেন— ‘এখনও অনেক জায়গায় শ্রমিকশ্রেণী লড়াই করছে, কৃষকরা সংগ্রাম করছেন।’
স্তালিন উত্তর দেন, ‘ভাঁটার সময়েও ছোট ছোট তরঙ্গ থাকে।’ যেকোনো আধা-সামন্ততান্ত্রিক,
আধা-ঔপনিবেশিক দেশে বিপ্লবী পরিস্থিতি উপস্থিত থাকে। কিন্তু বিপ্লবী পরিস্থিতি
থাকলেই যে বিপ্লব হবে এমনটা নয়। যতদিন না বিপ্লবী পরিস্থিতি বিপ্লবী সংকটে রূপান্তরিত
হচ্ছে ততদিন বিপ্লবের সম্ভাবনা থাকে না। এই বিপ্লবী সংকটকে কাজে লাগিয়ে বিপ্লব
করতে গেলে প্রয়োজন হয় বিষয়ীগত প্রচেষ্টার। আধা-উপনিবেশগুলোতে কখনও কখনও শাসকেরা স্বল্প
সময়ের মধ্যে বিপ্লবী সংকট কাটিয়ে ওঠে; কিন্তু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংকটগুলো বজায়
থাকায় আবার দ্রুত নতুন বিপ্লবী সংকটের জন্ম হয়। মাঝের সময়টুকুকে বলে ভাঁটার
মুহূর্ত—দুই জোয়ারের মধ্যবর্তী উত্তরণকালীন দশা। যত দিন এই দশা চলে তত দিন সংগঠনের
মূলরূপকে বিসর্জন না দিয়েও ‘জার্মান ভাষায়’ কথাবার্তা বলতে হয়, বলতে হয় যাতে সঠিক
সময়ে ‘ফরাসি ভাষায়’ প্রয়োগ সম্ভব হয়ে ওঠে।
এই সাধারণ সত্য সুজিত
কোনও দিন উপলব্ধি করতে পারেন নি। পরে যখন ঘা খেয়ে বুঝলেন বাম বিচ্যুতির শিকার
হয়েছেন তখন দেরি হয়ে গেছে অনেকটা। তবু শিক্ষা নেন নি তিনি। বাম বিচ্যুতিকে compensate করেছিলেন আর এক বিচ্যুতির
জন্ম দিয়ে—যার নাম দক্ষিণ সুবিধাবাদ। সংগঠনের অবস্থা ফেরাতে পার্টি সংগঠনের ওপরে
স্থান দিয়েছিলেন গণসংগঠনকে, সংগ্রামের সহায়ক রূপকে গড়ে তুলেছিলেন প্রধান রূপ
হিসাবে। ফলে মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলো বা রাষ্ট্রীয় বাহিনী যখন পার্টির ওপর ঝাঁপিয়ে
পড়ল, দু-এক জায়গায় ছাড়া সেরকম কোনও প্রতিরোধই করা গেল না। বিলুপ্ত হয়ে গেল দলটা।
যাইহোক, শত দোষের মধ্যেও লিন পিয়াও-পন্থীরা শেষ
পর্যন্ত সংগ্রাম জারি রাখার চেষ্টা করেছিলেন। পাহাড়-জঙ্গলে লুকিয়ে নয়, তাঁরা জায়গা
ক’রে নিয়েছিলেন
খেটে খাওয়া মানুষের পাশে—একেবারে সমতলভূমিতে। তাঁদের মাথা, মুখ, হাত চলেছিল সরল
রেখায়; যা মনে করেছিলেন সঠিক তাই বলেছিলেন, যা বলেছিলেন তাই কাজে পরিণত করার জন্য
সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। এই ভণ্ডামি ভরা ফাটকাবাজির দেশে এটুকুই বা ক’জন করে?